
সৌর বর্ষ: পৃথিবী সূর্যের চারপাশে একবার প্রদক্ষিণ করতে যে সময় লাগে সেই সময়টাই হলো সৌর বর্ষ। একটি সৌর বর্ষে প্রায় ৩৬৫.২৫ দিন থাকে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার, যা আমরা সাধারণত খ্রিস্টাব্দ নামে ব্যবহার করি, একটি সৌর ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডারে প্রতি বছরের মাস তারিখ ঠিক থাকে এবং ঋতুগুলো নির্দিষ্ট সময়ে আসে। খ্রিস্টাব্দ নামে পরিচিত এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার, ১ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয়নি। এর গণনা পদ্ধতি আরও জটিল এবং এটি বিভিন্ন ক্যালেন্ডারের বিবর্তন থেকে এসেছে।
জুলিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার
জুলিয়ান ক্যালেন্ডার (Julian Calendar): ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার এটি চালু করেন। এই ক্যালেন্ডারটি মূলত সৌর বছরকে ৩৬৫.২৫ দিন ধরে গণনা করত। এটিই ছিল ইউরোপে বহুল ব্যবহৃত ক্যালেন্ডার।
সংশোধন: জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতি বছর ০.০০৭৮ দিনের ত্রুটি ছিল, যার ফলে ১৫০০ বছরের মধ্যে প্রায় ১০ দিনের পার্থক্য দেখা দেয়। এই ত্রুটির কারণে বসন্ত বিষুব (Vernal Equinox) ক্রমশ পেছাতে থাকে, যা খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় উৎসব ইস্টার নির্ণয়ে সমস্যা তৈরি করে।
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের উৎপত্তি : পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি ১৫৮২ সালে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতি বছরের ০.০০৭৮ দিনের এই ত্রুটি দূর করার জন্য একটি নতুন ক্যালেন্ডার চালু করেন। আর সেটিই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত।
সংশোধনী: এই নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৫৮২ সালের ৪ অক্টোবর এর পরদিনকে ১৫ অক্টোবর ধরা হয়, ফলে ১০ দিনের পার্থক্য দূর হয়। এছাড়া, লিপ ইয়ারের (Leap Year) নিয়মেও পরিবর্তন আনা হয়। প্রতি ১০০ বছর পর লিপ ইয়ার বাদ দেওয়া হয়, তবে ৪০০ বছর পর পর তা আবার যুক্ত করা হয় (যেমন: ১৬০০, ২০০০ সাল লিপ ইয়ার ছিল, কিন্তু ১৭০০, ১৮০০, ১৯০০ ছিল না)।
খ্রিস্টাব্দের উৎপত্তি
৫২৫ খ্রিস্টাব্দে রোমান পণ্ডিত ডায়োনিসিয়াস এক্সিগুয়াস (Dionysius Exiguus) যিশু খ্রিস্টের জন্মসালকে গণনা করার চেষ্টা করেন। তিনি যিশুর জন্মসালকে ১ খ্রিস্টাব্দ হিসেবে প্রস্তাব করেন। তবে, এই গণনা পদ্ধতি তার সময়ে জনপ্রিয়তা পায়নি।
জনপ্রিয়তা লাভ: এই গণনা পদ্ধতিটি সপ্তম ও অষ্টম শতকে ঐতিহাসিক বিড (Historical Bede)-এর মাধ্যমে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর ধীরে ধীরে এটি ইউরোপে ব্যবহৃত হতে শুরু করে এবং গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হওয়ার পর এটি প্রায় সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয়। সুতরাং, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারটি ১৫৮২ সালে চালু হলেও এর খ্রিস্টাব্দের গণনা পদ্ধতি অনেক আগেই শুরু হয়েছিল, যা যিশুর জন্মসালকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল। তবে, ১ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই ক্যালেন্ডারের প্রচলন শুরু হয়নি। কারণ ১ খ্রিস্টাব্দের গণনা পদ্ধতিটি যিশুর জন্মকে ভিত্তি করে তৈরি হলেও ঐতিহাসিকদের মতে, যিশু খ্রিস্টের প্রকৃত জন্মসাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪ থেকে ৬ সালের মধ্যে।
কেন এই পার্থক্য?
গণনার ভুল: ডায়োনিসিয়াস এক্সিগুয়াস নামের যে পণ্ডিত প্রথম খ্রিস্টাব্দের গণনা পদ্ধতি তৈরি করেন, তিনি যিশুর জন্মসাল নির্ণয়ে সম্ভবত ভুল করেছিলেন। তিনি সেই সময়কার রোমান ক্যালেন্ডারের ওপর নির্ভর করে এই গণনা করেছিলেন, কিন্তু সে সময়কার তথ্য ছিল সীমিত এবং ত্রুটিপূর্ণ।
শূন্য সালের অভাব: ক্যালেন্ডারটিতে ১ খ্রিস্টাব্দের আগে কোনো শূন্য সাল (০) ছিল না। ১ খ্রিস্টাব্দের আগে ছিল ১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই শূন্য সালের অভাবের কারণে গণনায় আরও জটিলতা তৈরি হয়। আমরা বর্তমানে যে খ্রিস্টাব্দে অবস্থান করছি, তা মূলত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সময়ের একটি ধারাবাহিক গণনা। এটি যিশুর প্রকৃত জন্মসালের ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক ও গাণিতিক গণনা পদ্ধতি যা বহু শতাব্দী ধরে চলে আসছে। তাই, বর্তমান খ্রিস্টাব্দটি একটি প্রচলিত এবং গৃহীত গণনা, যা যিশুর প্রকৃত জন্মের বছর থেকে কয়েক বছর ভিন্ন।
চন্দ্র বর্ষ: চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ১২ বার সম্পূর্ণ প্রদক্ষিণ করতে যে সময় লাগে সেই সময়টাই হলো চন্দ্র বর্ষ। এটি প্রায় ৩৫৪ দিনে হয়। এ কারণে একটি চন্দ্র বর্ষে প্রায় ৩৫৪ দিন থাকে। এই বর্ষের প্রতিটি মাস (চন্দ্র মাস) শুরু হয় যখন চাঁদ একটি নতুন চক্র শুরু করে, অর্থাৎ যখন নতুন চাঁদ (New Moon) দেখা যায়। ইসলামি ক্যালেন্ডার (হিজরি সন) একটি খাঁটি চন্দ্র বর্ষের উদাহরণ। এই কারণে ইসলামি উৎসব যেমন রমজান, ঈদ ইত্যাদি প্রতি বছর সৌর ক্যালেন্ডারের তুলনায় প্রায় ১১ দিন করে এগিয়ে আসে। চন্দ্র বর্ষ অর্থাৎ যা বর্তমানে হিজরি সাল নামে পরিচিত, তা শুরু হয় শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় গমণ (হিজরত) এর বছর থেকে, যা ৬২২ খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ ৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয় ১ চন্দ্র বর্ষ বা ১ হিজরি সাল। চন্দ্র বর্ষ বা হিজরি সাল গণনা শুরুর সময়েও শূন্য সাল (০) ধরা হয়নি।
৩৩ সৌর বর্ষ সমান ৩৪ চন্দ্র বর্ষ
ব্যাখ্যা
সৌর বর্ষ: প্রতি সৌর বর্ষে ৩৬৫.২৫ দিন থাকে।
চন্দ্র বর্ষ: প্রতি চন্দ্র বর্ষে ৩৫৪.৩৭ দিন থাকে।
প্রতি বছর সৌর ও চন্দ্র বর্ষের মধ্যে প্রায় ১০.৮৮ দিনের পার্থক্য থাকে।
সৌর বছর×দিনের পার্থক্য=অতিরিক্ত দিন
৩৩×১০.৮৮=৩৫৯.০৪ দিন।
এখন, এই ১০.৮৮ দিনের পার্থক্য যদি আমরা যোগ করতে থাকি, তাহলে প্রতি ৩৩ সৌর বছরে প্রায় ৩৬০ দিন (প্রায় সৌর এক বছর) অতিরিক্ত হয়। আবার এই ৩৬০ দিন থেকে ৩৫৪.৩৭ দিনে একটি চন্দ্র বর্ষ পুর্ণ হয়। এই কারণে, ৩৩ সৌর বর্ষ পর একটি অতিরিক্ত চন্দ্র বর্ষ পুর্ণ হওয়ায় ৩৩ সৌর বর্ষ পর পর চন্দ্র বর্ষ ১ বছর বেড়ে যায়। তাই, ৩৩ সৌর বছরে ৩৪ চন্দ্র বছর পুর্ণ হয়।
এই হিসাবটি একটি সহজ পদ্ধতি, যা প্রায়শই ব্যবহৃত হয়। এটি থেকে বোঝা যায় যে কীভাবে চন্দ্র ক্যালেন্ডার সৌর ক্যালেন্ডারের তুলনায় দ্রুত এগিয়ে যায়।
লেখক : গাজী আবু বকর