বেক্সিমকোর ১৫ কারখানা চালু করতে আসছে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ

বিশেষ প্রতিবেদক : বেক্সিমকো গ্রুপের বন্ধ কারখানা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব কারখানা চালু করতে আপাতত ২৪৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে জাপানের রিভাইভাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আর এ প্রক্রিয়ায় রিভাইভালের সঙ্গে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইকোমিলি নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান। বেক্সিমকোর বন্ধ কারখানা চালুতে এই দুই প্রতিষ্ঠানের যৌথ বিনিয়োগের সিদ্ধান্তে সায় দিয়েছে সরকার। এখন অপেক্ষা ত্রিপক্ষীয় চুক্তির। পক্ষগুলো হলো রিভাইভাল, জনতা ব্যাংক ও বেক্সিমকো। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বেক্সিমকো গ্রুপের পোশাক পণ্যের বড় বিদেশি ক্রেতা জারা, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, টার্গেট, আমেরিকান ইগল, পুল অ্যান্ড বিয়ার ও বেস্ট সেলার ইত্যাদি। বিদেশি ক্রেতাদের কাছে চাহিদা থাকায় ১৫টি কারখানা নিয়ে গঠিত বেক্সিমকো টেক্সটাইলস ডিভিশন নতুন করে চালুর চেষ্টা চলছে। গত বছরের আগস্টে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব কারখানা চালু করতে রিভাইভাল প্রজেক্ট লিমিটেড ও যুক্তরাষ্ট্রের ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান ইকোমিলি যৌথভাবে দুই কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করতে চায়। এ জন্য তারা লিখিত একটি প্রস্তাবও দিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পাস করা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ছাত্রছাত্রীদের একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে, যার নাম বুয়েট ইনভেস্টমেন্ট নেটওয়ার্ক। এ নেটওয়ার্কের সহায়তায় পরবর্তী সময়ে বেক্সিমকোর কারখানা চালুর জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা হবে আরও ১০ কোটি ডলার—এমন আশ্বাসও সরকারকে দেওয়া হয়েছে।

বেক্সিমকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী বলেন, ‘আমরা জনতা ব্যাংকের কাছে খেলাপি। জনতা ব্যাংক কতটুকু, কীভাবে ঋণ পুনঃ তফসিল করবে, রিভাইভাল তা বুঝতে চায়। সে কারণেই রিভাইভালসহ ব্যাংকটির সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। এখন ত্রিপক্ষীয় চুক্তির পালা।’

সূত্রগুলো জানায়, প্রথম দফায় রিভাইভালের পক্ষ থেকে বেক্সিমকো টেক্সটাইল পরিচালনার জন্য সরকারের কাছে আগ্রহপত্র (ইওআই) জমা দেওয়া হয় গত জুনে। বেক্সিমকো যেহেতু জনতা ব্যাংকের কাছে বড় অঙ্কের ঋণখেলাপি, জাপানি কোম্পানিটি তাই জনতা ব্যাংকের নীতিগত সম্মতি চেয়েছে। রিভাইভালের এ আগ্রহের বিপরীতে বেক্সিমকো গ্রুপ লেটার অব কমফোর্ট বা নিশ্চয়তাপত্রও দাখিল করেছে মন্ত্রণালয়ে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধে বেক্সিমকোকে ৫৮৫ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দিয়েছে সরকার। সে টাকা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত। এদিকে ছয় মাস ধরে বন্ধ থাকার কারণে কারখানাটির যন্ত্রপাতি অকেজো হওয়ার পথে।

দুই সপ্তাহ আগে অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়া শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান এ নিয়ে গত ২১ আগস্ট সচিবালয়ে একটি বহুপক্ষীয় বৈঠক করেন। যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির চলমান ধারা অব্যাহত রাখতে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কারখানাগুলো চালু হচ্ছে। বেক্সিমকোর মূল্যবান যন্ত্রপাতি আছে, যেগুলো নষ্ট হচ্ছে এখন। কারখানা চালু হলে অনেকের কর্মসংস্থান হবে—সরকার এ বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে।

রিভাইভাল কী চায়
রিভাইভাল বলেছে, কারখানাগুলো চালু হবে ত্রিপক্ষীয় ইজারা চুক্তির মাধ্যমে। আর কারখানা চালু করতে হলে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করতে হবে। কারখানার চালুর পর যে আয় হবে, তার একাংশ সেবা মাশুল (সার্ভিস চার্জ) হিসেবে নেবে রিভাইভাল। বাকি আয় চলে যাবে পুনঃ তফসিল করা ঋণ পরিশোধে। কারখানা চালু করতে বিদেশি ব্যাংক থেকে দুই কোটি মার্কিন ডলারের ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্রের (এলসি) ব্যবস্থা করবে রিভাইভাল। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিশ্বখ্যাত নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেবে রিভাইভাল। বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা, দক্ষ কর্মী নিয়োগ ও টেকসই উৎপাদনও নিশ্চিত করবে তারা।

রিভাইভাল প্রজেক্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফয়সাল হুদা বর্তমানে জাপানে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘আশা করছি দুই সপ্তাহের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়ে যাবে। আমরা চাই না এটা হল-মার্ক হোক। বেক্সিমকোর কারখানাগুলো চালু করে আমরা ২৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চাই। আর বিশ্ববিখ্যাত যেসব ব্র্যান্ড বেক্সিমকো থেকে পণ্য নিত, তাদের ধরে রাখতে চাই।’

সরকারের মনোভাব
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধে সরকার ৫৮৫ কোটি টাকা বেক্সিমকোকে দিয়েছে। এর মধ্যে ৫৭৫ কোটি টাকা অর্থ বিভাগের। এ টাকা বেক্সিমকো গ্রুপ বা রিভাইভাল কীভাবে পরিশোধ করবে, তা জানতে চেয়েছে অর্থ বিভাগ। এ ছাড়া ঋণ পুনঃ তফসিলের জন্য অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অনাপত্তিপত্র লাগবে। উভয় বিভাগই কারখানা চালুর স্বার্থে অনাপত্তিপত্র দিচ্ছে।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) পক্ষ থেকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়, বিদেশি কোম্পানি বিনিয়োগ করতে এলে ব্যাংকগুলো থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই জনতা ব্যাংক ঋণ না দিলেও অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ রাখা যেতে পারে।

রিভাইভাল ও বেক্সিমকোর সঙ্গে গত ১৯ আগস্ট একটি বৈঠক করে জনতা ব্যাংক। সেখানে ঋণ পুনঃ তফসিল ও এলসি খোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তিপত্র চাওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

বেক্সিমকোর সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক বলেন, উদ্যোগটি ইতিবাচক। সরকারসহ সব পক্ষেরই এ ব্যাপারে সহযোগিতা করা উচিত। কারখানাগুলো চালু হলে ব্যাংকের টাকা ফেরত পাওয়া যেমন সহজ হবে, কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হবে।

নয়াবার্তা/আনোয়ারা পারভীন

Share