নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : কাকরাইলের ভূঁইয়া ম্যানশনের ফটকে এখন আর কর্মীদের ভিড় নেই। কারণ, এই ভবনের আলোচিত বাসিন্দা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট কয়েক দিন আগে ভবন ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন।এই ভবন ছাড়ার পর থেকে সম্রাটকে নিয়ে নানা গুজবের ডালপালাও ছড়াতে থাকে। কেউ বলেন, তিনি আটক হয়েছেন; কেউ বলেন, তিনি নীরবে দেশ ছেড়েছেন। আবার কেউ কেউ এক ধাপ এগিয়ে অজানা আশঙ্কার কথাও বলেছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, সম্রাট ঢাকায় আছেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতেই আছেন। সম্রাটকে আটকের ব্যাপারে তাঁরা সরকারের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় রয়েছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘সম্রাট বলে কোনো কথা নেই। অপরাধ যে-ই করবে, তাকেই আইনের আওতায় আনা হবে। আপনারা খুব শিগগির তা দেখবেন।’
পরিবারের একটি সূত্র জানিয়েছে, সম্রাট তাঁর মহাখালীর ডিওএইচএসের বাসায় নেই। তবে শুক্রবার রাতে তিনি স্ত্রী শারমিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। তিনি পারিবারিক বিষয়ে খোঁজখবর নেন। এর আগে শুক্রবার সাদাপোশাকের পুলিশ সেই বাসায় গিয়ে সম্রাটের খোঁজ করে।
সম্রাটের বক্তব্য জানতে গতকাল কয়েক দফা যোগাযোগ করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর নম্বরে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। সম্রাটের গ্রামের বাড়ি ফেনীর পরশুরামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে তাঁদের পরিবারের কেউ থাকেন না। সম্রাটের বড় ভাই বাদল চৌধুরী ঢাকায় ক্যাসিনো ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। ছোট ভাই রাশেদ ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন। তাঁর বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। মা বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকেন। ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের পর তাঁরাও গা ঢাকা দিয়েছেন।
এত দিন সরকারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারবাজি, দলের পদ কেনাবেচা, ফুটপাত নিয়ন্ত্রণসহ নানা ঘটনায় এই যুবলীগ নেতার নাম শোনা গেলেও ক্যাসিনো-কাণ্ডের পর তাঁর নাম প্রকাশ্যে এল। এখন ক্যাসিনো-কাণ্ডে যাঁদেরই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, তাঁরাই সম্রাটের নাম বলছেন বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
তবে অন্য এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সম্রাট আলোচিত হলেও গতকাল পর্যন্ত ক্যাসিনো-কাণ্ডে যে ১৭টি মামলা হয়েছে, তার একটিতেও তাঁর নাম নেই। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, সম্রাটকে গ্রেপ্তার করা হবে কি না, তা স্পষ্ট না হওয়ায় মামলায় জড়ানো হয়নি।
ক্লাবপাড়ার একাধিক সূত্র জানায়, মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় মোহামেডান, আরামবাগ, দিলকুশা, ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া ও ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে নিয়মিত ক্যাসিনো ছিল। ইয়ংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। অন্য পাঁচটি ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন সম্রাটের লোকজন। সম্রাটের হয়ে ক্যাসিনোগুলো দেখাশোনা করতেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসার ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। তাঁরাই এক বছর আগে পল্টনের প্রীতম-জামান টাওয়ারে ক্যাসিনো চালু করেন। পরে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। মমিনুল হক এখন সিঙ্গাপুরে। আবু কাওসার যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে এসেছেন বলে শোনা গেলেও তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
ফোনে যোগাযোগ করা হলে মমিনুল হক ক্যাসিনো চালানের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, যাঁরা এ কাজে যুক্ত, তাঁদের কাউকে তিনি বাড়ি থেকে ধরে আনেননি, সবাই স্বেচ্ছায় এসেছেন।
যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ বলেন, ১৬-১৭ সেপ্টেম্বরের পর সম্রাটের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ হয়নি। তিনি কোথায় আছেন, তা-ও জানেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের একজন নেতা বলেন, সম্রাটের সুবিধাভোগীদের তালিকায় মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, সংগঠনের সুবিধাভোগী, পুলিশ ও সাংবাদিক রয়েছেন। এ কারণে তাঁকে গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতস্তত করছে। তবে সম্রাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে পুরো অভিযানই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে সুবিধাভোগীদের নাম প্রকাশ করা ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে তাঁরা মনে করেন।
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বলেন, এ ধরনের ঘটনায় দৃশ্যত ফৌজদারি অপরাধ হয়েছে। ফৌজদারি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার—দুটোই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ। তদন্ত করে কার কতটুকু সম্পৃক্ততা, তা খুঁজে বের করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনতে হবে।