করোনার পরীক্ষাকেন্দ্র বাড়িয়ে দ্রুত রোগী শনাক্ত জরুরি

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। সমগ্র বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পরও মানুষ লকডাউন মানছে না। জরুরি প্রয়োজন ছাড়াই বিভিন্ন অজুহাতে ঘরের বাইরে ঘোরাফেরা করছে অনেকে।

আর চাহিদার তুলনায় পরীক্ষা করার কেন্দ্র খুবই কম। পর্যাপ্ত পরীক্ষার সুযোগ না থাকায় করোনার ঝুঁকি বাড়ছে। পরীক্ষা করতে ও ফলাফল পেতে আক্রান্ত রোগীকে অনেক জায়গায় যেতে হচ্ছে। এতে ব্যাপক হারে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে।

এ অবস্থায় দ্রুত করোনা শনাক্তের পরীক্ষাকেন্দ্র বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরা বলেন, সারাদেশে ৩৬টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পরীক্ষা চালু করতে হবে। একই সঙ্গে বেসরকারি যেসব হাসপাতালে পিসিআর মেশিন আছে, সেসব হাসপাতালেও পরীক্ষা দ্রুত চালু করতে হবে। আর হেলথ কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্যাম্পল সংগ্রহ করে পার্শ্ববর্তী মেডিক্যাল কলেজে পরীক্ষা করতে হবে।

পরীক্ষার মাধ্যমে যত বেশি শনাক্ত করা যাবে, তত বেশি পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। নইলে করোনায় লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন।

করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই মুহূর্তে করণীয় ছয়টি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশও এসব বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে কিছু কাজ বাংলাদেশ আগেই শুরু করতে পারত বলে মনে করছেন অনেকে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা এখনো অনেক বাকি। এই পরীক্ষা হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের।

করোনা নিয়ে ওয়ার্ল্ডোমিটার ওয়েবসাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুহার ইতালির প্রায় কাছাকাছি। এমনকি মৃত্যুতে এগিয়ে থাকা যুক্তরাজ্য, স্পেন ও ফ্রান্সের তুলনায় বাংলাদেশে প্রাণহানির সংখ্যা বেশি।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে মৃত্যুহারের দিক দিয়ে বাংলাদেশ সবার ওপরে। অন্যদিকে করোনার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে পরীক্ষার হার কম। মাত্র ১৮টি কেন্দ্রে পরীক্ষা হচ্ছে। একই সঙ্গে করোনা রোগীদের সুচিকিত্সা নিশ্চিত করতে রেসপেটরি মেডিসিন, বক্ষব্যাধী বিশেষজ্ঞ, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, অ্যানেসথেলজিস্ট ও ইপিডিওমোলজিস্ট—এই পাঁচ ধরনের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং টিম গঠন করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফুল্লাহ বলেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়িয়েছে। অর্থাত্, সংক্রমণের চতুর্থ ধাপে বাংলাদেশ। বর্তমানে দেশে ৩০ শতাংশ মানুষ করোনা বহন করছে। তবে অনেকে জানেন না। অনেকে এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। তিনি বলেন, হাঁচি, কাশি ও জ্বর হলে ঘরে থাকতে হবে। তবে এসবের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হলে অবশ্যই পরীক্ষা করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক প্রোভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন বলেন, পরীক্ষার পরিধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে শুরুতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একগুঁয়েমি ছিল।

আইইডিসিআর মনে করেছিল, তারা একাই সামাল দিতে পারবে, তারা ছাড়া আর কেউ পরীক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু সারাদেশে ৬০০ মাইক্রোবায়োলজিস্ট আছেন এবং সমপরিমাণ প্যাথলজিস্টও রয়েছেন। তারা করোনা পরীক্ষা করতে অভিজ্ঞ।

সব মেডিক্যাল কলেজে মাইক্রোবায়োলজি ও প্যাথলজি বিভাগ চালু আছে। কিন্তু শুরুতে সঠিক পরিকল্পনা ছিল না। আসলে মেডিক্যাল বিষয়ে পরিকল্পনা মেডিক্যাল পারসনদের দিয়ে করতে হবে। পলিসি মেকাররা শুধু লজিস্টিক সাপোর্ট দেবেন।

তিনি বলেন, পরীক্ষার পরিধি বাড়াতে হবে। তিনি একটি উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, নারায়ণগঞ্জের ২৫০ শয্যার হাসপাতালে ভর্তি এক করোনা রোগীর এক্সরের জন্য কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে পাঠানো হয়। নারায়ণগঞ্জের ঐ হাসপাতালে এক্সরে মেশিন নষ্ট। তাই রোগীকে ঢাকায় পাঠানো হয় বলে একজন কর্মকর্তা জানান।

এই ঘটনাগুলোও সংক্রমণ কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। এই অবস্থার নিরসন করতে হবে। প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও পরীক্ষা চালু করার দাবি জানান তিনি।

অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন বলেন, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিত্সাসেবায় কেন্দ্রীয় বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকদের প্যানেল গঠন করতে হবে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমানে দেশের ৫৪ জেলায় লকডাউন চলছে। কিন্তু কেউ লকডাউন মানে না। ৬৪ জেলায় কারফিউ দিতে হবে। মানুষকে বাসায় রাখতে হবে। হাঁচি, কাশি ও গলায় ব্যর্থ হলে পরীক্ষা করতে হবে। নইলে লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে।

তিনি বলেন, তথ্য গোপন করা যাবে না। কিন্তু করোনা আক্রান্ত অনেক রোগী তথ্য গোপন করে বিপদ বাড়িয়ে দিচ্ছেন—এতে অন্য রোগীরা চিকিত্সাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সম্প্রতি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালে অন্য রোগের সেবা নিতে এসেছিলেন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরও। এ কারণে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার-নার্স ও স্বাস্থ্য সেবাকর্মীদের কোয়ারেন্টাইনে যেতে হয়েছে।

রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালেও সম্প্রতি এক জন মাথায় টিউমার আক্রান্ত রোগী ভর্তি হন। সে করোনাও আক্রান্ত হওয়ায় পরবর্তীতে তাকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তার মৃত্যু হয়। তবে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের যে ওয়ার্ডে ঐ রোগী ছিলেন, সেই ওয়ার্ড বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অধ্যাপক ডা. খান মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের প্রতি সহনশীল হতে হবে। গরিবের বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দিতে হবে। ত্রাণ দেওয়ার নামে জনসমাগম করা যাবে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা নিয়ে সমস্যা ছিল। দেশের চিকিত্সা বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের বিভাগ চালু আছে। এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক তৈরি করা হয়। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আগে থেকে কিট দেওয়া হলে এখান থেকে প্রতিদিন অনেক পরীক্ষা করানো সম্ভব হত।

তিনি বলেন, দেরিতে হলেও এখানো পরীক্ষা চালু করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি কিট শেষ হয়ে যায়। কিট চাইতে গেলে মন্ত্রণালয়ের এক জন কর্মকর্তা বলেন, পরীক্ষা করে কি করবেন? এই হলো স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মনোভাব। তবে শেষ পর্যন্ত আরো ২ হাজার কিট তিনি পেয়েছেন।

অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, করোনায় আক্রান্তদের ৮০ শতাংশ ঘরে চিকিত্সাসেবা দেওয়া সম্ভব। ৫ শতাংশের ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয়। আর ১৫ শতাংশের হাসপাতালে রাখার প্রয়োজন পড়ে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, করোনার কারণে ইতিমধ্যে ৫৪ জেলা লকডাউন করা হয়েছে। আমাদের কাছে ৫০ হাজার কিট মজুত রয়েছে। পরীক্ষার পরিধি সব জায়গায় বাড়ানো হচ্ছে। সবারই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেন তিনি।

ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুই শিফটে করোনা রোগীদের পরীক্ষা চলছে। সেখানে প্রয়োজনীয় কিট রয়েছে। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. চিত্তরঞ্জন দেবনাথ বলেন, প্রতিদিন দুই শিফটে ১৮৮ জনের পরীক্ষা করা হচ্ছে। শুক্রবার ১৮ জনের পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নুরুন্নবী লাইজু বলেন, চাহিদা অনুযায়ী কিট পাচ্ছি।

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নওশাদ আলী বলেন, গত পয়েলা এপ্রিল থেকে পরীক্ষা চলছে। টেস্ট নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. অসিত ভূষণ দাস বলেন, চাহিদা অনুযায়ী কিট পাচ্ছি, কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সিলেট মেডিক্যাল কলেজেও পর্যাপ্ত কিট আছে।

চট্টগ্রামের সংক্রমণব্যাধি হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ হাসান বলেন, পরশুদিন ১ হাজার ৯০০ কিট পেয়েছি। শুক্রবার পরীক্ষায় ৩৩ জনের পজিটিভ রিপোর্ট আসে। খুলনা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আবুল আহাদ বলেন, তাদের ১ হাজার ৪৮৮টি কিট রয়েছে।

Share