নিজস্ব জেলা প্রতিবেদক : খুনের দায়ে মৃত্যুদণ্ড হয়েছিলো ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আসলাম ফকিরের। অবশ্য ‘মানসিক অসুস্থ’ হওয়ায় ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমা লাভ করেন তিনি। কিন্তু জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার দুই বছর পর আবারো আরেক খুনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে এই ‘মানসিক রোগি’ আসলাম ফকির। এই খুনির ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে মানিকদহ ইউনিয়নের বাসিন্দারা। অভিযোগ রয়েছে এই খুনিকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছেন কাজী জাফরউল্ল্যাহ।
বেশ নাটকীয়ভাবে মৃত্যুদণ্ড থেকে মুক্তি পান এই আসলাম ফকির। প্রথমবার ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয় দফায় অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে পাঁচ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৫ সালে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা পেয়েছিলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আসলাম ফকির। দুই দফায় প্রাণভিক্ষা, মানসিক অসুস্থতা এবং সর্বশেষ এক সংসদ সদস্যের পক্ষ থেকে বিশেষ দিবসে সাধারণ ক্ষমা লাভের আবেদনের মতো অনেক নাটকীয়তার পর ২০১৭ সালে ১৩ বছরের কারাভোগ শেষে মুক্ত হন তিনি। রাষ্ট্রপতির প্রাণভিক্ষায় সেবারের মতো বেঁচে ফিরলেও আবারো এক হত্যা মামলার প্রধান আসামি হলেন এই আসলাম ফকির।
মানিকদহ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সাহেব আলীকে হত্যার প্রধান আসামি আসলাম ফকির। তিনিসহ তার সমমনা ওসমান মাতুব্বর এবং জাহাঙ্গীর শেখের সাথে একই এলাকার শাজাহান মাতুব্বরের গ্রাম্য আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত মঙ্গলবার (২১ এপ্রিল) সকালে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। এক পর্যায় আসলাম ফকিরের লোকজন শাজাহান মাতুব্বরের লোকজনের বেশ কয়েকটি বাড়িঘর লুটপাট করে দামি জিনিসপত্র নিয়ে যায়। এ সময় তাদেরকে বাধা দিলে আসলাম ফকিরের লোকজন শাজাহান মাতুব্বরের সমর্থক শহিদ শেখকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে জখম করে। তাকে স্থানীয় জনতা উদ্ধার করে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি করলে সেখানে সে মারা যায়। নিহত শহিদ শেখ উক্ত গ্রামের জয়নাল শেখের পুত্র। এই হত্যাকাণ্ডের পর আসলাম ফকিরকে প্রধান আসামি করে ৫৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
অবশ্য স্থানীয় থানার একটি সূত্র জানায়, এই মামলা গ্রহণ না করার জন্যও তাদেরকে চাপ প্রয়োগ করেন কাজী জাফরউল্ল্যাহ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত মামলা গ্রহণ করা হয়েছে এবং আসলাম ফকিরসহ তার সহযোগিদের আটকের চেষ্টা চলছে।
মানিকদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তারেক সাঈদ বলেন, উক্ত ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সাহেব আলীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যাকারীরাই এলাকাটিকে উত্তপ্ত করে রেখেছে। সাহেব চেয়ারম্যানকে হত্যার প্রধান আসামি আসলাম ফকিরের ফাঁসির আদেশ হয়। পরবর্তীতে রাজনৈতিক বিবেচনায় তাকে রাষ্ট্রপতি সাধারণ ক্ষমা প্রদান করেন। জেল থেকে বের হয়ে এসে আসলাম ফকির গ্রামে অপরাজনীতি শুরু করে। আজকের ঘটনায় আসলাম ফকির নিজে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রামে একজন সাধারণ মানুষকে খুন করিয়েছে। আমরা গ্রামবাসী এসব খুনের সঠিক বিচার সহ এলাকার পরিবেশ শান্ত রাখতে প্রশাসনের সদয় দৃষ্টি কামনা করছি।
রাষ্ট্রপতির প্রাণভিক্ষা এবং দীর্ঘ কারাভোগের পর মুক্ত হয়ে আসলাম ফকিরের আবারো নতুন করে খুনের মামলায় জড়ানোর বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। এটা রীতিমতো প্রতারণা। তখন তারা বলেছিল আসলাম ফকির মানসিক রোগী। যদি আসলাম ফকির এই খুনের সঙ্গে জড়িত থাকে, তবে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও ঢাকা ল’ রিপোর্টস (ডিএলআর) এর সম্পাদক অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান বলেন, মানসিক রোগীর সার্টিফিকেট দিয়ে একজন খুনি রাষ্ট্রপতির প্রাণভিক্ষা পেয়েছিলেন। এরপর কারাগার থেকে বেরিয়ে আরেকটি খুনের মামলার প্রধান আসামি হয়েছেন। যেহেতু রাষ্ট্রপতি তাকে একবার প্রাণভিক্ষা দিয়েছেন সেহেতু ওই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন করতে পারবেন না। এখন যেটা জরুরি সেটা হলো মানসিক রোগীর যে সার্টিফিকেট দিয়ে ফাঁসির দণ্ড মওকুফ হয়েছিলো আসলাম ফকিরের এখন ওই সার্টিফিকেটগুলোর সত্যতা যাচাইয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির প্রাণভিক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে ওই আসামি কোন জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিলো কিনা বা কোন রাজনৈতিক প্রভাব এর পেছনে কাজ করেছে কিনা সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ মানসিক রোগীর সার্টিফিকেট দিয়ে রাষ্ট্রপতির প্রাণভিক্ষা পাওয়া ব্যক্তি আবার খুনের মামলার মুখ্য আসামি হয়েছেন সেটা তদন্তকারী কর্মকর্তাকে গুরুত্বের সাথে আমলে নিতে হবে।
তিনি বলেন, গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত ফাঁসির আসামিকে অনুকম্পা দেওয়ার রাষ্ট্রপতির যে সাংবিধানিক ক্ষমতা তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে আরো সচেতন হওয়া উচিত। কারণ এই ক্ষমতা প্রয়োগ নিয়ে উচ্চ আদালতের একটি রায় রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি তার এই সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইন-কানুন, বিচার-বিচক্ষনতা ও নজির দেখে তা প্রয়োগ করবেন।
ফরিদপুর ভাঙ্গা উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ কে এম সাহেদ আলী ওরফে সাহেব আলী মিয়াকে হত্যার ঘটনায় ফাঁসির দণ্ড হয়েছিল আসলামের। ২০১৩ সালের সালের ১৩ নভেম্বর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিন ধার্য হয়। সেখানে উপস্থিত থাকার জন্য চিঠিও দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট সকলকে। কিন্তু ১২ নভেম্বর হঠাৎ করেই কারাগারে অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করেন আসলাম। ফলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত করা হয়। এ সময় তার শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে প্রথমে পেছানো হয় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন। অন্যদিকে সেদিনই আসলামের পক্ষ থেকে দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করা হয়। এবার আবেদন মঞ্জুর হলে তার দণ্ড হ্রাস করে তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
তবে এখানেই শেষ নয়, প্রাণভিক্ষা পাওয়ার পর এবার চেষ্টা চলে তার সাজা কমিয়ে তাকে মুক্ত করার। বিশেষ দিবসে বন্দিদের সাধারণ ক্ষমা লাভের সুযোগ নিয়ে তাকে মুক্তি দেওয়ার আবেদন করা হয়। ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনানুষ্ঠানিক চিঠি দেন সংসদ সদস্য নিলুফার জাফরউল্যাহ। কিন্তু সে সময় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। ১৩ বছর ২ দিন কারাভোগের পর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট গাজীপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে মুক্তি পান আসলাম।
মুক্তির পর থেকে কাজী জাফরউল্ল্যাহর সঙ্গে অধিকাংশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আসলাম ফকির। এই আওয়ামী লীগ নেতার মাধ্যমেই আসলাম ফকিরের মুক্তির পর সংবর্ধনা প্রদান করা হয় বলে জানায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা, সদরপুর, চরভদ্রাসন) আসনের সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন বলেন, ‘একজন খুনের আসামিকে মুক্তি দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া এবং তারপর যেই ব্যক্তিকে খুন করা হয়েছে তার বাড়ির সামনে মঞ্চ করে সেই খুনির মুক্তিতে সংবর্ধনা দেয়ার মাধ্যমে খুন করাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন কাজী জাফরউল্যাহ। তার প্রশ্রয় পেয়েই এই খুনের আসামি আবারো খুন করার সাহস পেয়েছে। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করছি, একজন খুনিকে আশ্রয় দিয়ে জেল থেকে বের করে নিয়ে এসে আবারো খুনের উৎসাহ দেয়ায় আসলামের পাশাপাশি কাজী জাফরউল্ল্যাহরও শাস্তি হওয়া উচিত।
এদিকে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখনো এলাকার মানুষ ভয়ে আছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, আসলাম ও তার সহযোগীদের সবাই ভয় করে। যে কোন সময় যে কোন কিছু করে ফেলতে পারে তারা। তাকে মুক্তি দেয়ার পর থেকেই ভয়ের মধ্যে বসবাস করছে এই এলাকার মানুষজন।
এই খুনি কে মুক্তির জন্য সহযোগিতা করা কাজী জাফরউল্ল্যাহর শাস্তির দাবি জানান স্থানীয়রা।