নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক :‘তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০’ জারির পর সারাদেশে বিচারের জন্য ভার্চ্যুয়াল আদালত গঠন করা হয়েছে। সেসব আদালতে ভার্চ্যুয়ালি আবেদনের জন্য নির্দেশনাও জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। তবে নির্দেশনা অনুযায়ী ভার্চ্যুয়ালি শুনানি করা গেলেও আবেদন দাখিলের প্রক্রিয়া পুরোপুরি ভার্চ্যুয়াল হয়নি। আবেদন করতে গেলে বেশকিছু বিষয়ে ম্যানুয়াল পদ্ধতিই অনুসরণ করতে হচ্ছে। প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে গিয়ে পুরো পদ্ধতি আর ভার্চ্যুয়াল থাকছে না।
বিশেষ করে ওকালতনামা, বেইল বন্ড ও কোর্ট ফি সংগ্রহ করতে হচ্ছে আগের নিয়মেই। ঢাকার আদালতে আইনজীবী সমিতির নির্দিষ্ট বুথ থেকে সংগ্রহ করতে হয় ওকালতনামা ও বেইল বন্ড। তাই জামিন আবেদন করতে ওকালতনামা সংগ্রহ ও হাজত থেকে তা স্বাক্ষর করিয়ে আনতে আদালতে যেতেই হচ্ছে। কোর্ট ফির জন্যও দ্বারস্থ হতে হচ্ছে নির্দিষ্ট কাউন্টারের।
অনেক আইনজীবী কম্পিউটার ব্যবহারে অভ্যস্ত নন। তাই জামিনের আবেদন করতে নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে কম্পোজ করাতে হচ্ছে। তাই ভার্চ্যুয়াল কোর্ট নামে থাকলেও পুরো জামিন আবেদনের প্রস্তুতিতে তা আর ভার্চ্যুয়াল থাকছে না। শুধু শুনানির ক্ষেত্রেই ভার্চ্যুয়াল পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে।
এ অবস্থায় মঙ্গলবার (১২ মে) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের চারটি ভার্চ্যুয়াল কোর্টে ৩৪ জন ও মহানগর দায়রা জজ আদালতে বেশ কয়েকজন হাজতি আসামির জামিন মঞ্জুর করা হয়। আর সারাদেশের আদালতগুলোতে ১৪৪ জনের জামিন হয়েছে বলে জানা গেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক আইনজীবীই এই ব্যবস্থার সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, ভার্চ্যুয়াল কোর্ট আইনজীবীদের করোনা থেকে সুরক্ষা দিতে পারবে না। এটা বিচারকদের সুরক্ষার জন্য করা হয়েছে।
আইনজীবী এম কাওসার আহমেদ বলেন, ‘শুনলাম প্রথমদিন অনেকের জামিন হয়েছে। আমি মাদারীপুরে আছি, প্রথমে ভেবেছি এখান থেকেই আববেদন করে জামিন শুনানি করতে পারব। কিন্তু এখন দেখছি ঢাকায় চেম্বারে যাওয়া ছাড়া কাজ করা অসম্ভব। আমাদের যদি আদালতে যেতেই হয়, তাহলে তো আর সেটা ভার্চ্যুয়াল থাকছে না। শুধু শুনানির প্রক্রিয়া ভার্চ্যুয়াল, এতোটুকু বলা যায়।’
ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বলেন, ‘উদ্যোগ ভালো। তবে এখনই সফলতা পাওয়া যাবে না। কারণ ব্যক্তিগতভাবে অনেক আইনজীবী, বিশেষ করে নিম্ন আদালতে যারা প্র্যাকটিস করেন, তারা প্রযুক্তির সঙ্গে সেভাবে অভ্যস্ত না। তবে এই ব্যবস্থা চালু থাকলে দুই-এক বছর গেলে হয়তো কিছুটা সফলতা আসতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমি নিজে আইডি খুলিনি। বুঝতে পারছি না কীভাবে কী করতে হবে। এখন রাষ্ট্রপক্ষে শুনানির জন্য আইডি চাচ্ছে। মনে হচ্ছে চেম্বারে বা আদালতে যাওয়া ছাড়া বিষয়টি বোঝা সম্ভব না।’
ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর শাহজালাল কিবরিয়া বলেন, ‘আমার মনে হয় এই ভার্চ্যুয়াল কোর্ট সফল হবে না। কারণ বেশিরভাগ আইনজীবীই প্রযুক্তিতে এখনও ততোটা পারদর্শী না।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা প্রযুক্তিতে তুলনামূলক অভ্যস্ত। তবে এই ব্যবস্থা সফল করতে বিধিমালায় আরও সংস্কার প্রয়োজন বলে অনেকে মনে করেন।
ভার্চ্যুয়াল কোর্ট গঠনের পর হাইকোর্টে প্রথম জামিন আবেদন করা হয় সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদের পক্ষে। তার আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘এদেশের বিচারিক ইতিহাসে এটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে অতীব জরুরি বিষয়াবলী মাননীয় আদালতের নজরে আনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন এই সুযোগ থেকে জনগণ বঞ্চিত ছিল।’
তবে এই ব্যবস্থায় কিছু সমস্যা সমাধানের দাবি এই আইনজীবীর। তিনি বলেন, ‘একটি আবেদন দায়ের করার পর তা গৃহীত হয়েছে কিনা তার জন্য ইমেইলের জবাবের অপেক্ষায় থাকতে হয়। এটি স্বয়ংক্রিয় হলে ভালো হতো। তাছাড়া ওকালতনামা সংগ্রহের ক্ষেত্রে ভার্চ্যুয়াল ব্যবস্থা না থাকায় এই পদ্ধতি কিছুটা অসুবিধায় পড়েছে। জেল কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে অনলাইনের মাধ্যমে ওকালতনামা সংগ্রহ করার পদ্ধতি থাকলে অধিকতর সুবিধা হত।’
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, দ্রুত গতির ইন্টারনেট ও আইনজীবীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়া বিচার শুরু হওয়ায় ঢাকার বাইরের বেশকিছু জেলা আইনজীবী সমিতি ভার্চ্যুয়াল আদালতে অংশ নেবেন না বলে জানিয়েছেন।
এই অবস্থায় ভার্চ্যুয়াল কোর্টের সফলতা নিয়ে সন্দিহান ঢাকা আইনজীবী সমিতির নেতারা। সমিতির সাধারণ সম্পাদক হোসেন আলী খান হাসান বলেন, ‘যে প্রক্রিয়াই হোক, আইনজীবীদের কোর্টে আসতেই হচ্ছে। শুধু বিচারকের সামনে যেতে হচ্ছে না। আইনজীবীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। তাই অধিকাংশ আইনজীবী প্রক্রিয়াটা বুঝতে পারছেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইমেইলে আবেদন পাঠাতে হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্যকে দিয়ে কম্পোজ করাতে হয়। এরপর ভিডিও কনফারেন্স ক’জন আইনজীবী বোঝেন। সবার হাতে স্মার্টফোনও নেই। এ প্রক্রিয়ায় তাদের পক্ষে শুনানি করা সম্ভব হবে না। তাই সাধারণভাবে আদালত খুলে দিলে সেখানেই শারীরিক দূরত্ব মেনে শুনানির ব্যবস্থা করা সম্ভব।’
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতে গত ২৬ এপ্রিল সাধারণ ছুটিতে আদালত বন্ধ রেখে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
গত ৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভপতিত্বে গণভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০’ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
দু’দিন পর ৯ মে ভার্চুয়াল কোর্ট সম্পর্কিত অধ্যাদেশ জারি করা হয়। অধ্যাদেশে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বা ক্ষেত্রমত হাইকোর্ট বিভাগ, সময় সময়, প্র্যাকটিস নির্দেশনা (বিশেষ বা সাধারণ) জারি করতে পারবে।