২৭ বছর পর ‘খুঁজে পাওয়া’ হাসানকে খুন করে টুকরো টুকরো করল স্ত্রী-সন্তান

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : ২৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন মোহাম্মদ হাসান। ৬১ বছরের মানুষটা কোথায় ছিলেন তা-ও অজানা ছিল স্ত্রী-সন্তানদের কাছে। কিছুদিন আগে হুট করে বাড়ি ফিরে আসেন ‘নিখোঁজ’ হাসান। সেই ফেরাটাই কাল হলো তার জন্য। কোথায় বহুদিন পর খুঁজে পাওয়া হাসানকে মায়ায় জড়াবেন। উল্টো সম্পত্তি লিখে না দেওয়ায় পরিবারের সদস্যরা হাসানকে হত্যা করে মরদেহ ‍টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছেন খাল ও নালায়।

চট্টগ্রামে দুই দিন আগে ট্রলিব্যাগ থেকে উদ্ধার হওয়া মানবদেহের খণ্ডগুলো এই হাসানের। তার পরিচয় শনাক্তের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

স্ত্রী-সন্তান ও পুত্রবধূর হাতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হাসানের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কাথারিয়া ইউনিয়নের বড়ইতলী গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের সাহাব মিয়ার ছেলে। তবে পিবিআইয়ের উদ্ধার করা জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) হাসানের অস্থায়ী ঠিকানা লেখা আছে, সিলেট সদরের সাধুর বাজার সংলগ্ন রেলওয়ে কলোনির জামাল মিয়ার গ্যারেজ। ধারণা করা হচ্ছে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সিলেটের এই এলাকায় এতবছর ধরে থাকছিলেন হাসান।

পিবিআই নদী ও নালা থেকে ৮টি খণ্ডাংশ উদ্ধার করলেও মাথার হদিস এখনো পায়নি। সেটির খোঁজে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় নগরীর পতেঙ্গা বোট ক্লাবের অদূরে ১২ নম্বর গেটে একটি ট্রলিব্যাগ পায় পুলিশ। কফি রঙের সেই ট্রলিব্যাগে মানবদেহের ২ হাত, ২ পা, কনুই থেকে কাঁধ এবং হাঁটু থেকে উরু পর্যন্ত অংশ ছিল। এই ঘটনায় পতেঙ্গা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল কাদির বাদী হয়ে এক বা একাধিক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এরপর হত্যাকাণ্ডের রহস্য উম্মোচনে মাঠে নামে পিবিআই।

আঙুলের ছাপ ও নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে প্রথমে হাসানের পরিচয় নিশ্চিত হন পিবিআই। এরপর আকমল আলী রোড এলাকায় হাসানের ছোট ছেলের বাসার সন্ধান পান তারা। পরে বাসার আশপাশের সিসি ক্যামরার ফুটেজ সংগ্রহের পর পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় পিবিআইয়ের কর্মকর্তাদের কাছে। তারা সিসি ক্যামেরায় দেখতে পান হত্যার পর ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে শরীরের অংশবিশেষ বস্তায় ভরে বের করছিলেন হাসানের ছোট ছেলে সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীর। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে পিবিআই জানতে পারে, হত্যাকাণ্ডে শুধু ছোট ছেলে নয় ওই বাসায় হাসানের স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগম, বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান ও ছোট ছেলের স্ত্রী আনারকলিও সেই বাসায় ছিলেন। হাসানের অবস্থানও ছিল সেখানে।

মূলত হাসানকে হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে তথ্যপ্রমাণ গায়েব করতে। তবে পিবিআইয়ের তদন্তের জালে হাসানের স্ত্রী ও বড় ছেলে আটকা পড়ার পর বেরিয়ে আসে কোথায় ফেলা হয়েছে লাশের খণ্ডাংশ।

১৯ সেপ্টেম্বর রাতে চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড থানার আকমল আলী সড়কের পকেট গেইট এলাকার জমির ভিলার ৭ নম্বর বাসায় হাসানকে খুন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিটের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) একেএম মহিউদ্দিন সেলিম। তিনি বলেন, বাসাটি ছিল হাসানের ছোট ছেলের। সেখানে তিনি স্ত্রী-সন্তানসহ থাকেন। হত্যাকাণ্ডের দশদিন আগে চিকিৎসার নামে হাসানের স্ত্রী ছোট ছেলের সেই বাসায় আসেন। ঘটনার দিন বড় ছেলে মোস্তাফিজুরও সেই বাসায় যান। কৌশলে ডেকে নেওয়া হয় হাসানকেও। জমি নিয়ে রাতে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে স্ত্রী, দুই ছেলে এবং ছোট ছেলের স্ত্রী মিলে পরিকল্পিতভাবে হাসানকে খুন করেন।

লাশটি কেটে টুকরো টুকরো করা হয় জানিয়ে পিবিআইয়ের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রথমে ট্রলিব্যাগে করে লাশের আট টুকরো ফেলা হয় পতেঙ্গা ১২ নম্বর ঘাট এলাকার খালে। মাথা এবং বুকসহ শরীরের আরও কিছু অংশ ফেলা হয় নানা স্থানে। ছোট ছেলেই লাশের টুকরোগুলো নানাস্থানে ফেলার কাজটি করেন।

স্ত্রী ও বড় ছেলেকে হেফাজতে নেওয়ার পর তাদের তথ্য অনুযায়ী শনিবার আকমল আলী সড়কের খালপাড়ে একটি খাল থেকে বস্তাবন্দি অবস্থায় টেপে মোড়ানো শরীরের একটি খণ্ড উদ্ধার করা হয়েছে। তবে মাথাটি এখনো পাওয়া যায়নি।

পিবিআই সূত্র জানায়, বিচ্ছিন্ন থাকার ২৭-২৮ বছর পর সম্প্রতি ঘরে ফিরে আসেন হাসান। বাঁশখালীতে তার কিছু পৈতৃক সম্পদ আছে। ফেরার পর স্ত্রী-সন্তানেরা সম্পদগুলো তাদের নামে লিখে দিতে হাসানকে চাপ দিচ্ছিলেন। তবে হাসান তাদের কথা শোনেননি। এ কারণেই মূলত হত্যার শিকার হতে হলো তাকে। স্ত্রী ও বড় ছেলেকে আটক করা হলেও পালিয়ে গেছেন ছোট ছেলে ও তার স্ত্রী। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চালাচ্ছে পিবিআই।

Share