আইএমএফের বোর্ড মিটিংয়ে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় হবে ১১ ডিসেম্বর

গাজী আবু বকর : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ বাংলাদেশের অনুকুলে অনুমোদিত ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন বা ৪৭০ কোটি ডলার ঋণচুক্তি অব্যাহত রাখছে। এই চুক্তির অধিন ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ে নিট রিজার্ভ ও রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে যে শর্ত ছিলো সেই শর্ত শিথিলে আইএমএফের প্রতিনিধি দল সায় দিয়েছে। তবে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ছাড় হবে আগামি ১১ ডিসেম্বর আইএমএফের বোর্ড মিটিংয়ে। আইএমএফ ঋণ অনুমোদনের পর গত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮১ মিলিয়ন বা ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাবার কথা ছিলো আগামি নভেম্বর মাসে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে আইএমএফ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। আর ১৩ সদস্যের আইএমএফ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন মিশন প্রধান রাহুল আনন্দ। সরকারের সঙ্গে বৈঠকের শেষ দিন গতকাল বৃহস্পতিবার আইএমএফ মিশনের প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে এই সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকার ঋণ কর্মসূচির প্রথম পর্যালোচনা সম্পন্ন করার বিষয়ে ঐকমত্যে এসেছে। এতে বলা হয়, প্রথম পর্যালোচনা সম্পন্ন হওয়ার পর এক্সটেনডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি বা বর্ধিত ঋণ তহবিল (ইসিএফ) ও এক্সটেনডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটির (ইএফএফ) আওতায় ৪৬ কোটি ২০ লাখ আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় ২১ কোটি ৯০ লাখ ডলার ঋণ ছাড় হওয়ার কথা। অর্থাৎ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তিতে মোট ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ছাড় হতে পারে।

বিবৃতিতে আইএমএফের প্রতিনিধিদলের প্রধান রাহুল আনন্দ বলেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ও আইএমএফের প্রতিনিধিদল ২০২৩ সালের আর্টিকেল ৪ পর্যালোচনা করেছে এবং ইসিএফ/ইএফএফ/আরএসএফের অধীনে প্রথম পর্যালোচনা সম্পন্ন করতে যেসব প্রয়োজনীয় নীতি গ্রহণ করতে হবে, সে বিষয়ে ঐকমত্যে এসেছে। এ বিষয়ে কর্মকর্তা পর্যায়ের ঐকমত্য হয়েছে।

বাংলাদেশে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে যে অগ্রগতি হয়েছে, আইএমএফের প্রতিনিধিদল তাকে স্বাগত জানিয়েছে। সেই সঙ্গে চ্যালেঞ্জিং পরিবেশের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার যে নীতিগত ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে, তাকেও স্বাগত জানিয়েছে আইএমএফ। বিবৃতিতে বলা হয়, এবারের আলোচনার ভিত্তিতে প্রতিনিধিদল প্রতিবেদন প্রণয়ন করে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদে আলোচনা ও সিদ্ধান্তের জন্য পেশ করবে। পর্ষদ এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এ কাজ শেষ হবে বলে জানানো হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে বলে মনে করে আইএমএফ। তাদের পূর্বাভাস, চলতি অর্থবছরের শেষার্ধে মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ স্বল্প মেয়াদে ধারাবাহিকভাবে বাড়বে এবং মধ্য মেয়াদে চার মাসের আমদানির সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ থাকবে বলে তাদের পূর্বাভাস। তবে এই পূর্বাভাস ঘিরে উচ্চ মাত্রার অনিশ্চয়তা আছে বলেও জানিয়েছে তারা, ঝুঁকিও আছে।

বিবৃতিতে আইএমএফ আরও জানায়, স্বল্প মেয়াদে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে বাংলাদেশকে আরও কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন মুদ্রা সরবরাহ আরও সংকুচিত করা এবং তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতি ও মুদ্রার বিনিময় হার আরও নমনীয় করা। তবে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। এ ছাড়া অর্থনীতি যেভাবে নানা কারণে ব্যাহত হচ্ছে, তার প্রভাব যেন অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর ওপর যেন তেমন একটা না পড়ে, তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে আইএমএফ। বাংলাদেশ ব্যাংক যে ৪ অক্টোবর নীতি সুদহার ৭৫ ভিত্তি পয়েন্ট বৃদ্ধি করেছে, তাকে স্বাগত জানিয়েছে তারা।
বিবৃতিতে রাহুল আনন্দ আরও বলেন, সামাজিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ও বিনিয়োগের জন্য রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত অনেক কম, এই পরিস্থিতিতে টেকসইভাবে কর সংগ্রহ বাড়াতে সমন্বিত কর নীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রয়োজন। এ ছাড়া ভর্তুকির যৌক্তিকীকরণ, ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আর্থিক ঝুঁকি মোকাবিলা করা গেলে সামাজিক নিরাপত্তা খাত ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে তিনি মনে করেন।

অর্থনীতির বহিঃস্থ খাতের ঝড়ঝাপটা মোকাবিলায় মুদ্রা ও বিনিময় হার নীতি কাঠামোর আধুনিকীকরণ এবং ব্যবস্থাপনার উন্নতি গুরুত্বপূর্ণ। সুদহারের ক্ষেত্রে করিডর ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং একীভূত একক বিনিময় হার গ্রহণের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে আইএমএফ। তাদের পরামর্শ, এর ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ ব্যাংককে সুদের হারের ‘টার্গেটিং ফ্রেমওয়ার্ক’ পুরোপুরি চালু করাসহ ধীরে ধীরে নমনীয় বিনিময় হার ব্যবস্থায় যেতে হবে। এদিকে দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থায়নের চাহিদা মেটাতে ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা মোকাবিলা করা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে আইএমএফ। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ হ্রাস করা, তত্ত্বাবধান বৃদ্ধি করা, শাসনব্যবস্থা জোরদার করা ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর উন্নতি করা গেলে আর্থিক খাতের দক্ষতা বাড়বে। এ ছাড়া প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাজারের উন্নয়ন অর্থায়ন প্রক্রিয়া গতিশীল করতে সহায়তা করবে।

বৈঠক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে সফররত আইএমএফ মিশন দল ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। বর্তমানে আইএমএফের রিজার্ভ হিসাব করার পদ্ধতির ষষ্ঠ সংস্করণ বিপিএম৬ অনুযায়ী, বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। নিট হিসাব করলে এই পরিমাণ আরো কমে ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। এই পরিস্থিতিতে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা রিজার্ভের শর্ত শিথিল করার জন্য অনুরোধ করে। অনুরোধের প্রেক্ষাপটে আইএমএফ শর্ত শিথিল করে চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষে রিজার্ভ ১৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার এবং আগামী বছর জুন শেষে তা ২০ বিলিয়ন ডলার রাখার কথা বলেছে। এ ছাড়াও আইএমএফ চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকারকে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল, সেটিও কমাতে রাজি হয়েছে। লক্ষ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছিল ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এখন তা কমিয়ে নতুন লক্ষ্য দেয়া হয়েছে ৩ লাখ ৯৪ হাজার কোটি টাকা। তবে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, এ সংশোধিত লক্ষ্য অর্জনও কঠিন হবে। কারণ আমদানি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয়ার সুযোগ কম। আবার কর ছাড়ও কমানো যাবে না। ফলে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব সংগ্রহে বড় ধরনের উলম্ফন সম্ভব হবে না।

বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক সাংবাদিকদের জানান, রিজার্ভ নিয়ে বললেও নিট রিজার্ভ নিয়ে কথা বলেননি তিনি। আজকের বৈঠকে দ্বিতীয় কিস্তির শর্ত চূড়ান্ত করা হয়। ঋণ চুক্তিতে থাকা বাংলাদেশের প্রথম কিস্তির অর্থ ব্যবহারের অগ্রগতি দেখে পরবর্তী কিস্তি ছাড়ের জন্য আইএমএফের আর্টিকেল-ফোরের অধীনে রিভিউ মিশনের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসে গত ৪ অক্টোবর। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির জন্য দেওয়া ৬ শর্তের দুই শর্ত পূরণ করতে পারিনি। বাকিগুলো পূরণ হয়েছে। তবে দুটি শর্ত কেন পূরণ করা যায়নি তার ব্যাখ্যা আইএমএফকে আমরা দিয়েছি। ব্যাখ্যায় তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছে। আগামী ১১ ডিসেম্বর আইএমএফের বোর্ড মিটিং আছে। আশা করছি সেখানে দ্বিতীয় কিস্তির অনুমোদন আসবে। আমরা ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাবো।’ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে তিনি বলেন, ‘নিট রিজার্ভ সম্পর্কে আমি এখন বুঝতে পারছি না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাব সম্পর্কে বলতে পারবো। বিপিএম ৬ অনুযায়ী হিসাব প্রতি সপ্তাহে ওয়েবসাইটে আপলোড করা হচ্ছে।’ মেজবাউল হক আরও বলেন, ‘আমরা যে দুই শর্ত পূরণ করতে পারিনি তার একটি নিট রিজার্ভ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৫ দশমিক ৩ বিলিয়নে রাখা, সেটা হয়নি। অন্যটি হলো রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন। রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় ১৪ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে।’ এই ঋণের জন্য বেশকিছু শর্ত দেয় আইএমএফ। এগুলোর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারমুখী করা, ব্যাংক ঋণে সুদ হারের ৯ শতাংশের সীমা তুলে দেওয়া, ব্যাংক ঋণের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তথ্য প্রকাশ, রিজার্ভের হিসাব আইএমএফ স্বীকৃত পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী করে প্রকাশ, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, শেয়ারবাজারের উন্নয়নসহ বেশকিছু আর্থিক ও নীতি সংস্কারে মধ্যে দিয়ে যেতে হয় বাংলাদেশকে। এর আগে ঋণ আলোচনায় সরকার, মন্ত্রণালয়, সরকারি দপ্তর ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছিল আইএমএফ। এবার আসা রিভিউ মিশনের প্রতিনিধিরা প্রথমবারের মতো ব্যাংক খাতের নির্বাহীদের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করেন।

উল্লেখ্য, আইএমএফ সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আটকে দিয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার কমে আসায় শ্রীলঙ্কা নীতি সুদহার ১০০ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে দেওয়ায় সংস্থাটি শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ আটকে দেয়। ফলে বাংলাদেশ আইএমএফের সকল শর্ত শতভাগ পুরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮১ মিলিয়ন বা ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাবার বিষয়ে সন্দিহান ছিলো।

Share