আফগানিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বলি


জেমস কে গ্যালব্রেইথ : আফগানিস্তানবিষয়ক অনেক বেদনাসঞ্জাত সত্য এখন সংবাদমাধ্যমে বেশ জোরেশোরে প্রচার হচ্ছে। এমনকি প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমেও এসব সত্য উঠে আসছে। যেমন একটি প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, ‘আফগান যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ—সবই হয়েছে রাজনৈতিক কারণে, সে রাজনীতি আফগানিস্তানের ভেতরকার রাজনীতি নয়, তা আদতে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরকার রাজনীতি।’

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নথি অনুযায়ী, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল, তা পরিচালিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের মাটি থেকে। যারা এ হামলা চালিয়েছিল, তারা বিমান প্রশিক্ষণ নিয়েছিল ফ্লোরিডা থেকে। হামলার মূল ছক যারা করেছিল, তাদের বেশির ভাগই ছিল সৌদি নাগরিক। আল–কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন সুদান ত্যাগ করার পর আফগানিস্তানে তাঁর আস্তানা গড়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি পাকিস্তানে চলে যান। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। ১১ সেপ্টেম্বরের সেই হামলায় আফগানিস্তানের তৎকালীন তালেবান সরকারের কোনো নেতা জড়িত ছিলেন—এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না।

কিন্তু ২০০১ সালে আফগানিস্তানে ভীষণ দ্রুততায় যুক্তরাষ্ট্র অভিযান চালিয়েছিল। এ অভিযান যে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নির্ণায়ক বিষয় ছিল, তা এখন বোঝা যাচ্ছে। জর্জ বুশ ক্ষমতায় বসার পর থেকেই রিপাবলিকান পার্টির জনপ্রিয়তায় ধস নামতে শুরু করে এবং ভারমন্টের রিপাবলিকান সিনেটর জেমস জেফর্ডস পক্ষ ত্যাগ করায় রিপাবলিকানরা সিনেটের নিয়ন্ত্রণ হারান। আফগানিস্তানে অভিযানের মধ্য দিয়ে বুশ রিপাবলিকান পার্টির জনপ্রিয়তা আবার ফিরিয়ে আনেন।

আমেরিকান ভোটাররা দ্রুততার সঙ্গে পরিচালিত, সহজসাধ্য ও কম খরচের যুদ্ধে বিজয়ী হওয়াকে সমর্থন করে। কিন্তু পৃথিবীর আরেক প্রান্তের একটি পার্বত্য ও ঊষর এলাকায় উদ্দেশ্যহীনভাবে মার্কিন বাহিনী অনির্দিষ্টকাল লড়াই করে যাবে এবং সেই বাবদ কঁাড়ি কঁাড়ি অর্থ খরচ করতে হবে—এ ধারণার সঙ্গে তারা একমত নয়। বিশেষ করে তারা যখন হাজার হাজার মানুষের অহেতুক মৃত্যু, হাজার হাজার মানুষের পঙ্গু হয়ে যাওয়া এবং অগণিত মানুষের আহত হয়ে শয্যায় শুয়ে আর্তচিৎকার করতে দেখেছে, তখন তারা সে যুদ্ধের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছ।

পূর্বসূরি জর্জ বুশের কাছ থেকে বারাক ওবামা ২০০৯ সালে ‘উত্তরাধিকারসূত্রে’ যখন আফগান যুদ্ধের দায়িত্ব পেলেন, তখন আফগান যুদ্ধ থেকে লাভবান হওয়ার মতো কিছুই ছিল না। কিন্তু তারপরও শুধু রাজনৈতিক কারণে তাঁকে এ যুদ্ধে সমর্থন দিয়ে যেতে হয়েছে। ইরাক যুদ্ধে তিনি যে বিরোধিতা করছিলেন, সেই বিরোধিতার যুক্তিকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য তাঁকে আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়েছিল। ২০১১ সালের মে মাসে লাদেনকে হত্যার মধ্য দিয়ে ওবামা বলা যায় কিছুই অর্জন করতে পারেননি। লাদেনকে হত্যার সিদ্ধান্তের প্রতি মার্কিন জনগণের সমর্থনের সূচকে মাত্র এক মাসের জন্য উল্লম্ফন হয়েছিল।

ওবামা সবচেয়ে ভালো রাজনৈতিক খেলা দেখিয়েছেন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আফগানিস্তানের নাম ফলাও হতে না দিয়ে। ভেতরে-ভেতরে আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী যে মার খাচ্ছে তা সংবাদমাধ্যমে আসতে না দিয়ে তিনি তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে সংহত রাখছিলেন। ওবামার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এসে ইরাক, লিবিয়ার ছোট ছোট যুদ্ধ থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে আনতে শুরু করেন। এটা ঠিক যে ট্রাম্পের সময়ই আইএসের উত্থান হয়েছিল। আইএসের মূলোৎপাটন করতে গিয়ে মসুল ও রাকা—এ দুটি শহরকে প্রায় ধ্বংস করে ট্রাম্প বুঝতে পারেন, তাতে তাঁর তেমন কোনো রাজনৈতিক লাভ হয়নি।

এরপরই তিনি আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া শুরু করেন আর সে প্রক্রিয়া শেষ হয় তাঁর উত্তরসূরি জো বাইডেনের মাধ্যমে। বাইডেন ভালো করেই বুঝতে পারছেন, আফগানিস্তানে বিপুল পরিমাণে সামরিক ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো লাভ হচ্ছে না। এ যুদ্ধ প্রলম্বিত করলে ভোটাররা তাঁর দিকেই অর্থ অপচয়ের অভিযোগ তুলবে। ইতিমধ্যেই মার্কিন নাগরিকদের অনেক সরকারি সুবিধার পরিধি সংকুচিত হয়েছে এবং বাইরের দেশে মার্কিন সামরিক ব্যয়কেই এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে। মার্কিন নাগরিকেরা এতে ক্ষুব্ধ। সুতরাং সেই রাজনীতি মাথায় রেখেই জো বাইডেন তাঁর পূর্বসূরি ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত মেনে আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়েছেন।

জেমস কে গ্যালব্রেইথ ইকোনমিস্টস ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির একজন ট্রাস্টি

Share