একটি ক্লাসে বাবুল নামে দু’জন ছেলে আছে। বন্ধুরা কীভাবে তাদের আইডেন্টিফাই করেন? এ ক্ষেত্রে দারুণ চটজলদি একটা কৌশল আছে। আমরা মুহূর্তেই তাদের দু’জনের দৈহিক, বাহ্যিক কিংবা মানসিক খুঁত খুঁজে বের করি এবং সে অনুযায়ী সহাস্যে বীরদর্পে নামকরণ করি। যেমন হতে পারে ‘কালা বা কাইল্লা বাবুল’, ‘ধলা বাবুল’। ভার্টিকেল খুঁত বিচারে হতে পারে ‘বাইট্টা বাবুল’, ‘লম্বু বাবুল’ কিংবা ‘খাম্বা বাবুল’। হরাইজন্টালি গেলে, ‘ভোটকা’, ‘হোদল’, ‘মোটকা’ কিংবা ‘খাসি বাবুল’ আর ‘শুঁটকি বা ট্যাংরা বাবুল’। বুদ্ধির পরিমাপকে যদি আমাদের মতো ‘আশরাফুল মাখলুকাতরা’ নামকরণের মাপকাঠি হিসেবে নিই তখন বলি ‘গাধা বাবুল’; আরেকজন ‘বদ বাবুল’। এ রকম বহু নামকরণের সমীকরণ আমাদের জানা আছে। সবকিছুই তাদের খুঁত বিষয়ক। আমরা অবলীলায় খুঁতগুলোকে বারবার স্মরণ করিয়ে প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছি যুগ যুগ ধরে। একজন শুরু করে, বাকিরা হাসে এবং আস্তে আস্তে সেই খুঁত প্রাধান্য পাওয়া নাম হয়ে যায় তার সামাজিক আইডেন্টিটি! আর কেমন গা-সওয়া হয়ে গেছে ব্যাপারটা। কিন্তু একবার ওই মাপকাঠিগুলো নিজের নামের সঙ্গে জড়িয়ে দেখেন তো ভালো লাগে কি-না? নিছক আনন্দ মনে হয় কি-না? আচ্ছা, যুগ যুগ ধরে চলা এই ‘নিছক আনন্দ’ তাদের কতটুকু কষ্ট দিয়েছে তার হিসাব করেছি কখনও?
আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদের আপনজন বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের কাছে হেনস্তা হচ্ছি। বিশ্বাস করুন, যাকে নিয়ে এই ‘নিছক হাস্যরস’ করা হয়, তার কিন্তু একদম ভালো লাগে না। সে অভ্যাসে পরিণত করে নিয়েছে এসব। কিন্তু প্রতিবারই এই খুঁত ধরে হ্যাঁচকা টান তার গায়ে বেঁধে ড্রিল ফোটার মতো!
আমার মনে হয়, আমাদের সমাজে অনেক সমস্যার মাঝে অন্যতম সমস্যা হলো, প্রতিটা বিষয়ে আমরা মনে করি, আমাদের জ্ঞান আছে এবং অপর পক্ষ চাক বা না চাক, একটি উপদেশ দেওয়ার জন্মগত অধিকার আমাদের আছে! সেদিন এক বিশাল জ্ঞানী রিকশাওয়ালার পাল্লায় পড়েছিলাম।
কারও সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হলেই খেয়াল করে দেখবেন, আমরা তার সঙ্গে ঠিক কীভাবে আলাপন শুরু করি। ‘কী ব্যাপার, দিন দিন এত মোটা হচ্ছ কেন?’, ‘তোমাকে দেখতে এত ক্লান্ত লাগছে কেন? কী হয়েছে তোমার চেহারার?’ যাদের বিয়ের বয়স কিন্তু বিয়ে হয়নি তাদের ক্ষেত্রে তো অবশ্যম্ভাবী সম্ভাষণ- ‘বিয়ে করছ কবে?’ কিংবা তাদের বাবা-মাকে বলি, ‘ভাই/আপা, আপনার মেয়ের/ছেলের বিয়ে দেবেন না?’ এসব প্রশ্ন করার আগে আমাদের কি একবারও মনে হয় না, যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, সে এই সমাজেরই একটা অংশ। সে এবং তার পরিবারও জানে, এই সমাজ বিয়ের একটা নির্দিষ্ট বয়স বেঁধে দিয়েছে। তারাও হয়তো হন্যে হয়ে পাত্র কিংবা পাত্রী খুঁজছে। সবকিছু না মেলায় বিয়েটা হচ্ছে না। এর ভেতর আমি যদি সত্যি উৎকণ্ঠিত থাকি, তবে তাদের বুঝমতো জোড়া মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। তা না হলে আমার এই ‘মূল্যবান’ উপদেশ নিজের কাছে রাখাই শ্রেয়।
যদি আপনি বিবাহিত হন এবং বছর গড়িয়ে গেলেও সন্তান না নিয়ে থাকেন তাহলে তো বড়-ছোট সবাই পারলে ঝাঁপিয়ে পড়বে আপনার ওপর। একের পর এক প্রশ্ন করেই যাবে। ব্যক্তিগত প্রশ্ন? আপনাকে বাচ্চা নেওয়া রিলেটেড প্রশ্ন করা তখন পুরো জাতির অধিকার। ‘কী ব্যাপার! আর কত অপেক্ষা করবে?’, ‘কোনো সমস্যা?’, ‘আমাদের নতুন মুখ কবে দেখাবে?’- এসব প্রশ্নের সম্মুখীন অবশ্য এই সমাজে মেয়েরাই বেশি হয়। আর যদি মেয়ে কর্মজীবী হয়, তাহলে তো বাচ্চা না হওয়ার ১০০% কারণ চাকরি। তখনকার প্রশ্নের ধরন হয়, ‘এত ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করে কী হবে?’, ‘চাকরি করে এত স্ট্রেস নিয়ে কনসিভ করে না। অমুক ভাইয়ের তমুক বউয়েরও তাই হয়েছিল।’ একটাবার ভাবে না, এই প্রশ্নগুলো একান্ত ব্যক্তিগত, বাচ্চা চাওয়া না চাওয়া স্বামীর সিদ্ধান্তও হতে পারে। তাদের মানসিক প্রস্তুতির কারণেও হতে পারে। আবার এমনও তো হতে পারে, তারা নিজেরাও চাচ্ছে, কিন্তু বিধাতা রাজি নন। কম আর বেশি প্রত্যেক মানুষেরই বাবা-মা হওয়া একটা ঐশ্বরিক স্বপ্নের মতো। আর এর সময়-সংখ্যা সব ওই ওপরওয়ালাই নির্ধারণ করেন। বিধাতা কাউকে না চাইতেই সন্তান দেন, কারও আশা পূরণ হতে কয়েক বছর গড়ায়। আবার কারও আশা চিরকাল অপূর্ণ থেকে যায়। এই অপেক্ষা, এই আশা-নিরাশায় দোদুল্যমান অবস্থায় থাকা মানুষদের বুক-চেরা কষ্ট এবং সন্তানের আশায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুধু যার হয় সে-ই বোঝে! বুঝি না কেবল সবজান্তা শমসের আমরা। ওই ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে কাঁটা চামচ চালাই নিছক উপদেশ দিয়ে অথবা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে! তাদের রীতিমতো অপদস্থ করি।
ভাবছেন, সন্তান ধারণ করলেই মুক্তি পাবেন? এক সন্তান হলে ‘দ্বিতীয়টা কবে হবে?’, ‘ভাইবোন ছাড়া বাচ্চা খুব দুঃখ নিয়ে, একাকিত্ব নিয়ে বড় হয়’, ‘সেসব বাচ্চা অসামাজিক হয়, স্বার্থপর হয়!’ এ জাতীয় প্রশ্নে বিব্রত করে তুলি আমরা প্রতিনিয়ত জানাশোনা বা পাশের মানুষদের। এতে তারা বিব্রত হয়। কারণ সেই বাবা-মায়েরও স্বপ্ন ছিল দ্বিতীয় বাচ্চার। হয়তো অনেকবার চেষ্টার পরও তারা দ্বিতীয় বাচ্চার মুখ দেখেনি। বারবার মিসক্যারেজ হয়েছে; বারবার ওই রক্তপিণ্ড তাকে সন্তান হারানোর মতোই কষ্ট দিয়েছে! হেরে যাওয়া মাতৃত্ববোধের যন্ত্রণায় কেঁদেছে, কিন্তু আপনাকে বলেনি। বুকফাটা আর্তনাদ বালিশের নিচেই চাপা পড়েছে। কারণ এই সমাজ তাদের নাম দিয়েছে ‘কাক বন্ধ্যা’। যার একেবারেই সন্তান নেই, সেই মেয়েদের আমরা নাম দিয়েছি ‘বন্ধ্যা’!
দুটি সন্তান হয়ে গেছে- ভাবছেন নিশ্চিত? সেখানেও আমরা ছাড় দিই না। সেদিন দেখলাম আমার এক আত্মীয়ের দুই মেয়ে। কিন্তু হঠাৎ তিনি আবার সন্তানসম্ভবা। কিন্তু তিনিও ভীষণ লজ্জিত- এই বয়সে মানুষ কী বলবে, তা ভেবে। তার পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন কেউ বাকি নেই তাকে টিপ্পনী কাটা থেকে। এমনও বলেছে, ‘এখন তো তোমার মেয়ে বিয়ে দেওয়ার কথা। এখন আবার এসব কী!’ বেচারা পুরোটা প্রেগন্যান্সি টাইম ঘরেই লুকিয়ে কাটিয়েছে।
এ রকম আমি অনেককে চিনি, যারা আপাতদৃষ্টিতে সমাজের বেঁধে দেওয়া ‘সুন্দরী’ তালিকায় পড়ে না বিধায় বিলম্বিত বিয়ের কোটায় পড়ে আছেন। তাই সমাজ-সংসার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। সন্তানের জন্য আশায় বুক বেঁধে রাখা বাবা-মায়েরা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান একটু এড়িয়ে চলেন। বারবার এই অপদস্থ হওয়া কার ভালো লাগে!
এসব ব্যাপার এত চোখে পড়ত না, যদি আমার কিছু বিদেশি বন্ধুর সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য না হতো। আমি তিন মাস তিনটা মেয়ের সঙ্গে বাসা শেয়ার করে থেকেছিলাম পিএইচডির শেষদিকে। ওরা একজন ইন্দোনেশিয়ান, একজন ইজিপশিয়ান, একজন বাংলাদেশি। কিন্তু চার পুরুষ ধরে লন্ডনেই আছে। আমি অবাক হয়ে দেখতাম, তারা কারও সঙ্গে দেখা হলেই প্রথমে একটা প্রশংসা করে। যেমন, ‘তোমায় দেখতে খুব সুন্দর লাগছে’, ‘তোমার হাসিটা এখনও আগের মতোই মিষ্টি আছে।’ যতবার আমি বাইরে থেকে ঘরে ঢুকেছি ততবার সম্ভাষণ ছিল, ‘তুমি অনেক কষ্ট করে এসেছ নিশ্চয়ই। আমি তোমাকে এক কাপ চা করে দিই?’ আবার ওরাই বাইরে থেকে আমার পরে ঘরে ফিরলে ওদের কথা শুরু হতো, ‘তুমি ভালো ছিলে তো? ঘরের কাজে কি ক্লান্ত লাগছে? আমি কিছু করে দেব?’ এই তিন মাসে আমি একটা দিনের জন্যও তাদের কারও খুঁত নিয়ে কথা বলতে শুনিনি; কাউকে ছোট করে উপহাস করতে শুনিনি। তাদের বন্ধুরা যখন বেড়াতে আসত, তাদেরও দেখিনি পরচর্চায় মেতে উঠতে। মাঝেমধ্যে আমি ওদের গল্পের সঙ্গী হয়ে দেখেছি; এরা সারাক্ষণ মুখিয়ে থাকে কে কাকে সাহায্য করবে। কেউ এক কাপ চা এগিয়ে দিলে ধন্যবাদের বন্যা বইয়ে দেয়। ঠিক কবে তা আমারও কিছুটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল বলতে পারব না। তবে আমিও সবাইকে দেখে একটা প্রশংসা করা, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, পরচর্চা না করা প্রায় ধাতস্থ করে ফেলেছিলাম। ধাতস্থ যে করেছিলাম, তার প্রমাণ হলো দেশে ফিরে এসে। বিশাল বড় একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। স্বভাবতই দেশে ফেরার পর কাছে-দূরের সব আত্মীয় দেখা করতে এসেছিল অথবা আমিই গিয়েছি। প্রায় প্রতিবারই বেশিরভাগ আত্মীয়ের প্রথম সম্ভাষণ ছিল- ‘ওমা, তুমি তো বিদেশ থেকে আরও কালো হয়ে এসেছো’ অথবা ‘কী ব্যাপার! বিদেশি খাবার দেখি তোমাকে মোটা বানিয়ে ছেড়েছে!’ ‘তোমার চোখের নিচে এত কালি কেন?’ অথবা ‘এত দিন পর এলে, ক’দিন পর তো আর চিনবেই না।’
আমি জানি, এসব কথার পেছনে হয়তো বা মায়া আছে কিংবা এসব বলাই সামাজিক প্রথা হয়ে গেছে। কিন্তু কেন? এই সমাজে আমরা যে যে যার যার জায়গায় লড়ছি। যার যার জায়গায় দুঃখ-সুখ মিশিয়ে প্রাণপণে ভালোভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। কেউ সেই চেষ্টায় অনেক বেশি দৃঢ়, কেউবা দুর্বল। কী হয়- আমরা যদি একে অপরকে ভালোবেসে এই উপহাস থেকে দূরে থাকি? টিপ্পনী কাটার বদলে যদি একটু আনন্দ বিলাই; একটু ভালো কথা, একটু আশ্বাস দিই; না চাইলে উপদেশ দেওয়া থেকে বিরত থাকি? ব্যক্তিগত প্রশ্ন করাকে অসভ্যতা ধরে নিয়ে প্রত্যেককে তার নিজের মতো থাকাকে সম্মান জানাই। আস্তিক-নাস্তিক সবাই তো মানব ধর্মকে বুকে লালন করি। তাহলে আমরা তো পারি প্রতিনিয়ত নিছক উপহাস ছেড়ে ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়াতে।