নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : কুড়িগ্রামের বাংলা ট্রিবিউনের জেলা প্রতিনিধি অধূমপায়ী আরিফুল ইসলামকে আটকের পর এক পোয়া মদ ও ১০০ গ্রাম গাঁজা রাখার অভিযোগ এনে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানের সময় মাদকসহ আরিফুল ইসলাম রিগানকে আটক করা হয় বলে দাবি করেছেন অভিযান পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা। তবে আরিফুল ইসলামের স্ত্রী মোস্তারিমা সরদার বলেছেন, ‘মধ্যরাতে বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকে আরিফকে পেটানো, জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কোনো মাদক পাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। কারণ আরিফুল অধূমপায়ী।
‘মাদকবিরোধী অভিযানের’ উদ্যোগ জেলা প্রশাসন নাকি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কুড়িগ্রাম জেলা কার্যালয় নিয়েছিল, তা নিয়ে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক ও জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালকের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে।
গত শুক্রবার রাত ১২টার দিকে আরিফকে কুড়িগ্রাম শহরের চড়ুয়াপাড়াস্থ বাড়ি থেকে আটকের পর সাজা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
রাতের বেলায় এক সাংবাদিককে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে রংপুর বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন। তাঁকে এ ব্যাপারে আজকালের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
অভিযান পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ, আনসার ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে টাস্কফোর্সের অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ অভিযানের সময় মাদকসহ আরিফুল ইসলাম রিগানকে আটক করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে তিনি দোষ স্বীকার করায় এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
আরিফের স্ত্রী মোস্তারিমার অভিযোগ, কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন তাঁর নিজ নামে একটি পুকুর করেছিলেন। আরিফুল এ বিষয়ে রিপোর্ট করেছিলেন। এ ছাড়া সম্প্রতি একটি নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন। এ সবই তাঁর কাল হয়েছে।
তবে মোস্তারিমার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা প্রশাসক বলেছেন, ‘আমার নামে কোনা পুকুরের নামকরণ হয়নি। এক বছর আগে এমন প্রতিবেদন করেছিলেন আরিফুল। এ জন্য তিনি ক্ষমাও চেয়েছেন। ওটা বিষয় না।’
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘অ্যাজ ইউজুয়াল টাস্কফোর্স অভিযানে গেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিসের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আমার একজন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের কয়েকজন ফোর্স, ব্যাটালিয়ন আনসারের পাঁচজন আর মাদকদ্রব্যের তিনজন ছিলেন। তাঁদের কাছে লিখিত অভিযোগ ছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই অভিযান হয়। মাদকদ্রব্যই আমাদের কাছে ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছিল।’
তবে আজ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কুড়িগ্রাম জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবু জাফর বলেছেন, তিনি এলাকায় ছিলেন না। আজ শনিবার দুপুরে কার্যালয়ের পরিদর্শক জাহিদ তাঁকে জানিয়েছেন, রাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের অভিযানের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়।
আবু জাফরের এই বক্তব্য জেলা প্রশাসককে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘মাদকদ্রব্য কার্যালয়ের পক্ষ থেকেই চাওয়া হয়েছিল। তারপর এরা (ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা) বলেছে যে যাওয়া যাবে। অবশ্য আমি তো কাল ছিলামও না, আমি রৌমারিতে ছিলাম।’
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, তাঁরা বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য রংপুর বিভাগের কমিশনারকে বলেছেন।। আজকালের মধ্যে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামও বলেছেন, বিভাগীয় কমিশনারকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। সেখান থেকে অতিরিক্ত কমিশনারকে ঘটনাস্থলে পাঠানোও হয়েছে।
আরিফের স্ত্রী গতকাল রাতের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাতে ঘুমোনোর আয়োজন চলছে, সেই সময়ে দরজায় আঘাত। কে ডাকছে, এ প্রশ্নে কোনো সাড়া নেই। সন্দেহ তাই বাড়ে। আরিফুল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে ফোন দেওয়ার যখন চেষ্টা করেছেন, তখনই হুড়মুড় করে দরজা ভেঙে সাত–আটজনের একটি দল ঢুকে পড়ে। তাদের মধ্যে তিনজন জাপটে ধরে আরিফুলকে পেটাতে থাকে। আমাকেও মারার উপক্রম করে, গালিগালাজ চলতে থাকে। একজন আরিফুলকে বলে, “তুই খুব জ্বালাচ্ছিস।”’
মোস্তারিমা বলেন, গতকালের অভিযানে অন্তত ৪০ জন ছিলেন। আজ শনিবার জেলা প্রশাসকের অফিসে তাঁদের ডাকা হয়। পরিবারের কয়েকজনকে সঙ্গে করে নিয়ে যান তিনি। মোস্তারিমার অভিযোগ, সেখানে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার নাজিমউদ্দিন বলেন, ‘পানিতে থেকে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করবেন না।’ তবে নাজিমউদ্দিন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘উনি আমার সম্পর্কে না, অন্য কারও কথা হয়তো বলেছেন। আমি এ ধরনের কথা বলিনি।’
এর আগে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন একটি পুকুর সংস্কার করে নিজের নামে নামকরণ করতে চেয়েছিলেন। আরিফুল এ বিষয়ে নিউজ করার পর থেকেই তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ডিসি। এছাড়া, সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন অনিয়ম ও মুজিববর্ষের টানা নয়-ছয় নিয়ে রিপোর্ট করতে চেয়েছিলেন সাংবাদিক আরিফ। এ বিষয়ে জানতে পেরে জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে তাকে বেশ কয়েকবার ডেকে নিয়ে সতর্ক করা হয়। তবে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বাংলাট্রিবিউনডটকমের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাঁরা বিষয়টি আইনমন্ত্রী ও যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। আজ শনিবার বন্ধের দিন থাকায় আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেননি। আরিফুল ইসলামের জন্য তাঁরা প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপে যাবেন।
আরিফের আটক ও সাজার আইনি ব্যাখ্যা দিতে পারেননি ডিসি সুলতানা : মধ্যরাতে টাস্কফোর্স অভিযানের নামে কাউকে তুলে নিয়ে মোবাইল কোর্টে তার শাস্তি দেওয়া যায় কীভাবে, তার আইনি ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভীন। তিনি বলেন, ‘আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে গ্যাপ থাকলে দেখা হবে।’
বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগানের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ ছিল প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘টাস্কফোর্সের অভিযান ছিল। এটা ম্যাজিস্ট্রেট পরিচালনা করেছে রেগুলার শিডিউলের অধীনে। সঙ্গে মাদকদ্রব্য অধিদফতরের লোক, পুলিশ, আনসার ছিল।’
টাস্কফোর্সের অভিযান চালিয়ে মোবাইল কোর্ট আইনে সাজা দেওয়া ঠিক আছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আইনের মধ্যে হয়েছে। তারা সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকলে আপিল করবে, দেখবো আমরা।’
একটি পুকুর নিজের নামে নামকরণ করা সংক্রান্ত প্রতিবেদনের কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে এরকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা তো এক বছর আগের ঘটনা। আর রিপোর্টটিও মিথ্যা। এরকম কিছু হলে তো তখনই হতো। আর এই রিপোর্টের জন্য তো সে স্যরি বলেছে। আমরা ভিনডিকটিভ (প্রতিহিংসাপরায়ণ) না।’
সাংবাদিক আরিফকে গ্রেফতার ও নির্যাতন: দেশজুড়ে প্রতিবাদ : টাস্কফোর্স অভিযানের নামে মধ্যরাতে ঘরের দরজা ভেঙে মারধর করে বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগানকে তুলে নিয়ে যেয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এক বছরের জেল দেওয়া হয়েছে। শনিবার (১৪ মার্চ) সকালে এসব তথ্য ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান সাংবাদিকরা। দেশের বিভিন্ন জেলায় মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ ও প্রেস ক্লাবের বৈঠক থেকে এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করা হয়েছে।
জানা যায়, শুক্রবার (১৩ মার্চ) রাত সাড়ে ১২টায় ডিসি অফিসের দুই-তিন জন ম্যাজিস্ট্রেট ১৫-১৬ জন আনসার সদস্যকে নিয়ে দরজা ভেঙে তার বাসায় প্রবেশ করে। ঘরে ঢুকেই আরিফুল ইসলামকে উদ্দেশ করে ‘তুই অনেক জ্বালাচ্ছিস’ বলে মারধর শুরু করে এবং তুলে নিয়ে যায়। রাত ২টার দিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে। পরে আরিফের বাসায় আধা বোতল মদ ও দেড়শ’ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছে তারা। তবে আরিফের স্ত্রী জানিয়েছেন, সেসময় ঘরে কোনও তল্লাশিই চালানো হয়নি। দরজা ভেঙে আরিফকে মারধর করে তুলে নিয়ে গেছেন তারা।
শনিবার (১৪ মার্চ) কারাগারে আরিফের সঙ্গে দেখা করে আসার পর তার স্ত্রী মোস্তারিমা নিতু বলেন, ‘আরিফ জানিয়েছেন, রাতে তাকে মারধর করতে করতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে তার কাপড় খুলে দু’চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে। পুরো দৃশ্য ভিডিও করা হয়েছে সেসময়।’
মোস্তারিমা সরদার নিতু আরও জানান, ‘আমার স্বামী খুবই অসুস্থ। সে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না। আমাদের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলার মতো শক্তি ছিল না তার।’ এই ঘটনার ব্যাপারে স্থানীয় সংগঠক, শিক্ষক এবং রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির সভাপতি নাহিদ হাসান বলেন, ‘এখানকার একজন সৎ ও সাহসী সাংবাদিক উনি (আরিফুল ইসলাম)। উনার ওপর হামলাকে আমরা বাক স্বাধীনতার ওপর হামলা বলে মনে করছি। আরিফুল ইসলামকে আমরা নিজেদের (স্থানীয়দের) মুখপাত্র বলেই মনে করি, তিনি সেভাবেই নিজেকে গড়ে তুলেছেন। তার ওপর এই হামলাকে আমরা কুড়িগ্রামবাসীর ওপর আঘাত বলেই মনে করছি। ডিসির এই আইনবিরোধী কাজে আমরা ক্ষুব্ধ।’ এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চেয়েছেন তিনি।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কুড়িগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক দুলাল বোস বলেছেন, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের আল্টিমেটাম দিচ্ছি আমরা। এই ঘটনার প্রতিবাদে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাব, স্থানীয় বাসিন্দাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরা মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে।’
জানা যায়, কুড়িগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে মানববন্ধন করেছে জেলার নাগরিক সমাজ ও সাংবাদিকরা। এসময় বক্তারা বলেন, ‘নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট আনসার সদস্যদের নিয়ে আরিফুলের বাড়িতে গিয়ে দরজা ভেঙে প্রবেশ করে স্ত্রী-সন্তানের সামনেই মারধর করে। এরপর আধা বোতল মদ ও দেড়শ’ গ্রাম গাঁজা রাখার অভিযোগে তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আমরা এই মিথ্যা মামলার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন মাগুরার সাংবাদিকরা। মাগুরা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ খান বলেন, ‘একজন সাংবাদিককে মধ্যরাতে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং তার প্রতি শারীরিক নির্যাতন দুঃখজনক। প্রকৃত দোষীকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।’
টেলিভিশন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, মাগুরার সভাপতি অলোক বোস বলেন, ‘এটি সারাদেশের সাংবাদিকদের জন্য একটি অশনিসংকেত।’
নীলফামারী টেলিভিশন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিল্লাদুর রহমান মামুন জানান, দুর্নীতি ঢাকতে জেলা প্রশাসক একজন সংবাদকর্মীকে রাতের অন্ধকারে সাজা দিয়েছেন। নীলফামারী টেলিভিশন ফোরামের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
নীলফামারী প্রেস ক্লাবের সভাপতি তাহমিনুল হক ববি জানান, একটি নিউজের জন্য একজন জেলা প্রশাসক বেআইনিভাবে এই কাজ করতে পারে না। এটা ডিসির ব্যক্তিগত আক্রোশ। আরিফুলকে দ্রুত মুক্তি দেওয়ার জন্য আইনমন্ত্রীর দৃষ্টি কামনা করছি।
টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট জাফর আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক কাজী জাকেরুল মওলা বলেন, ‘সাংবাদিক আরিফকে মুক্তি দিয়ে সারাদেশের সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি করছি।’ এর সঙ্গে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের জন্য তদন্তের দাবি করেন তিনি। টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক ছাড়াও জেলায় কর্মরত প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরাও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান।
তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা সাংবাদিক ইউনিয়ন। সংগঠনের সভাপতি আব্দুস সালাম ও সাধারণ সম্পাদক আমির হুসাইন স্মিথ এক বিবৃতিতে জানান, এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত প্রশাসনের সেই কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য দাবি জানাই।
এই ঘটনার দ্রুত তদন্ত ও মূল ঘটনা প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি এ জেড এম ইমাম উদ্দিন মুক্তা।
এছাড়া ময়মনসিংহ টেলিভিশন রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি বাবুল হোসেন জানান, অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে আরিফুল ইসলামকে মুক্তি দেওয়াসহ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হচ্ছে।
কুড়িগ্রামের ডিসিকে প্রত্যাহার এবং এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়েছে লক্ষ্মীপুর প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকে।
এই ঘটনায় প্রতিবাদ সভা করেছেন জয়পুরহাট প্রেস ক্লাবের সাংবাদিকরা।
তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন ঝিনাইদহ জেলাসহ ছয় উপজেলার সাংবাদিকরা।
যশোরের সাংবাদিকরা এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, ‘স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এই ঘটনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
যশোর প্রেস ক্লাব সম্পাদক আহসান কবীর বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের মতো দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তার কাছ থেকে এমন আচরণ অপ্রত্যাশিত।’ তিনি অবিলম্বে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার এবং সাংবাদিক আরিফুলের মুক্তি দাবি করেছেন।
যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সাজেদ রহমান বলেন, ‘গভীররাতে বাড়ির দরজা ভেঙে প্রবেশ, স্ত্রী ও সন্তানদের সামনে মারধর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা রীতিমতো বিস্ময়কর।’
সাংবাদিক ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক আকরামুজ্জামান বলেন, ‘সরকার একদিকে বলছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। আবার দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করা হলে মারধর করে জেলে পাঠানোর মতো ঘটনাও ঘটানো হচ্ছে।’
যশোর জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শেখ দিনু আহমেদ বলেন, ‘সাংবাদিক নির্যাতনকারী ওই জেলা প্রশাসকের অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
টিভি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন যশোরের আহ্বায়ক সাকিরুল কবীর রিটন বলেন, ‘সত্য সংবাদ প্রকাশে একজন সরকারি কর্মকর্তার এই ধরনের আচরণ উদ্বেগের কারণ।’
বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন যশোর জেলার সভাপতি মনিরুজ্জামান মুনির বলেন, ‘আমরা এই ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছি। অবিলম্বে আমরা ওই জেলা প্রশাসকের প্রত্যাহার দাবি করছি, পাশাপাশি সাংবাদিক আরিফুলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি চাইছি।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি জাফরুল আলম জানান, আইনের লোক হয়ে গভীর রাতে বাড়িতে জোর করে প্রবেশ করে তাকে উঠিয়ে নিয়ে এসে ডিসি অফিসে সাজা দেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি। এটা আরও স্পষ্ট, মাদকের যে উপকরণ দেখানো হয়েছে তা আশপাশের কেউ দেখেনি। কাজেই ব্যক্তি আক্রোশেই যে এটা করা হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
জেলা প্রেস ক্লাব চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল হুদা অলক এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
সিটি প্রেস ক্লাব চাঁপাইনবাবগঞ্জের সভাপতি সাজেদুল হক সাজু জানান, ‘এ ধরনের কাজ মাঠপর্যায়ে সরকার ও প্রশাসনের ওপর জনগণের আস্থা কমায়।’
বরগুনা প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে এক জরুরি সভার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। প্রেস ক্লাবের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে বরগুনা জেলা টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরাম, প্রিন্ট মিডিয়া সাংবাদিক ফোরাম ও বরগুনা জেলা অনলাইন সাংবাদিক ফোরাম।
প্রেস ক্লাব সভাপতি অ্যাডভোকেট সঞ্জীব দাসের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর সালেহ, সাবেক সভাপতি চিত্ত রঞ্জন শীল, মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু, সহ-সভাপতি হাফিজুর রহমান, সাংবাদিক হারুন-অর-রশিদ রিংকু প্রমুখ।
বরগুনা জেলা অনলাইন সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সুমন সিকদার বলেন, ‘পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া ঘরের দরজা ভেঙে মারধর করে তাকে তুলে আনার পেছনের ঘটনা ও এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানাই।’
বরগুনা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর সালেহ বলেন, ‘পুলিশ ছাড়া আনসার সদস্য নিয়ে একজন সাংবাদিককে গভীর রাতে তুলে এনে সাজা দেওয়ার তীব্র নিন্দা এবং ঘটনার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাই।’
বরগুনা প্রেস ক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট সঞ্জীব দাস বলেন, ‘কুড়িগ্রামের ঘটনা আমাদের সাংবাদিকদের জন্য লজ্জার। এই ঘটনার জন্য দায়ীদের প্রতি ধিক্কার জানাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে আগামী দিনে আরও কর্মসূচি প্রদান করা হবে।’
বাংলা ট্রিবিউনের আলোচিত সেই রিপোর্ট :-“কাবিখা’র টাকায় পুকুর সংস্কার করে ডিসি’র নামে নামকরণ!”
কুড়িগ্রাম শহরে সরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ের অনুদানে পুকুর সংস্কার করে জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীনের নাম অনুসারে ‘সুলতানা সরোবর’ রাখা হয়েছে। এ নিয়ে জেলাজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বইছে সমালোচনার ঝড়। জেলার সচেতন মহলের প্রশ্ন, সরকারি অর্থ ব্যয়ে পুকুর সংস্কার করে জেলা প্রশাসকের নাম কেন দেওয়া হবে?
কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) প্রকল্প থেকে এই পুকুর সংস্কারের জন্য চাল ও সোলার স্ট্রিট লাইট বরাদ্দের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা খন্দকার মো. মিজানুর রহমান।
কুড়িগ্রাম শহরের ‘নিউ টাউন পার্ক’ নামে পরিচিত এই পুকুরটি ৪০ বছরের পুরনো।
জানা গেছে, ১৯৭৮ সালে কুড়িগ্রাম শহরে এই পুকুর খনন করা হয়। নাম দেওয়া হয় ‘নিউ টাউন পার্ক’। পুকুরটিতে মাছ চাষ করা হতো। পাশাপাশি এর পাড়ে গড়ে ওঠে নার্সারি। তবে বিভিন্ন সময় পুকুর পাড়ে অসামাজিক কার্যকলাপ চলার অভিযোগ ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক জেলা প্রশাসকের পরিকল্পনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসন পুকুরটি সংস্কার করে এর পাড়ে সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ নেয়। বর্তমান জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন পুকুরটির সংস্কার কাজ শুরু করেন।
সংস্কার কাজের অংশ হিসেবে পুকুরটি পুনঃখনন করে চারপাশে ওয়াকওয়ে তৈরি করে স্থাপন করা হয় সোলার স্ট্রিট ল্যাম্প। পুকুর সংস্কারের বিষয়টি সব মহলে প্রশংসিত হলেও বিপত্তি ঘটে এর নাম পরিবর্তনের খবরে।
গত ১৪ মে জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তার ছবিসহ পুকুরের নতুন নাম (সুলতানা সরোবর) সংবলিত একটি পোস্ট দেন। এরপর জেলাজুড়ে শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা।
সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দশম সংসদের কুড়িগ্রাম-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য তাজুল ইসলাম চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার অনুকূলে টিআর কাবিখা’র বরাদ্দ অর্থ থেকে পুকুরটি সংস্কার কাজ করা হয়। এতে প্রায় ১০৪ দশমিক ৫৫৫ মেট্রিক টন চাল এবং ২৫টি সোলার স্ট্রিট ল্যাম্প বরাদ্দ দেওয়া হয়। এছাড়া অন্য স্থান থেকে ৩১টি সোলার স্ট্রিট ল্যাম্পের বরাদ্দ কেটে এই পুকুর পাড়ে স্থাপন করা হয়। এছাড়াও জেলার কিছু ব্যক্তি অনুদানও দেন।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদ দুলাল বোস বলেন, ‘রাষ্ট্রের টাকায় কোনও সংস্কার কাজ করে জেলা প্রশাসক নিজের নামে নামকরণ করতে পারেন না। তিনি সরকারি দায়িত্ব পালন করতে জেলায় এসেছেন।’
রেল, নৌ-যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি নাহিদ হাসান বলেন, ‘এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে যায় না। জনগণের টাকায় পুকুর সংস্কার হওয়ায় জেলার কোনও কৃতী সন্তানের নামেই এটির নামকরণ করা উচিত।’
এদিকে, বিষয়টি নিয়ে তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে। তারা অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন।
মো. মাইদুল ইসলাম মাহিন তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘জনগণের টাকায় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নিজের নামে পুকুরের নাম দিয়েছেন, অথচ ডিসি কোয়ার্টারের পেছনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পী কছিম উদ্দীনের জমি অধিগ্রহণ করে তাকে ভূমিহীন করা হয়েছে। পুকুরটি কছিম উদ্দীনের নামে বা সৈয়দ শামসুল হকের নামে কিংবা তারামন বিবির নামে হতে পারতো। এতে ডিসির সুনাম বাড়তো।’
জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন অস্ট্রেলিয়া সফরে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে এ বিষয়ে তার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি কোনও উত্তর দেননি।
জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, “পুকুরটির নামকরণ নিয়ে জেলাজুড়ে সমালোচনার বিষয়টি আমরা জেনেছি। কুড়িগ্রামের কিছু মানুষ ‘সুলতানা সরোবর’ নামকরণের প্রস্তাব করে তারাই আবার সমালোচনা করছেন। তবে ডিসি স্যার দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে এ নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক বলেন, ‘সংস্কারের পর পুকুরের নতুন নামকরণ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।’
কাবিখা’র টাকায় পুকুর সংস্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক বলেন, ‘কিছু মানুষের অনুদানের টাকায় পুকুরটি সংস্কার করা হয়েছে। কাবিখা’র টাকা এতে ব্যয় করা হয়নি।’