নয়াবার্তা প্রতিবেদক : রাজধানীর কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের চার শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী মাসের পর মাস নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না।ফলে দুর্বিষহ জীবন কাটছে তাঁদের।১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত খ্যাতনামা এই শিক্ষালয় ডুবে আছে নানা সংকট আর অনিয়মে।২০২১ সালের ২৩ অক্টোবর শেষ হয় স্কুলটির পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ।ওই বছরের নভেম্বরে বিধি ভেঙে প্রভাব খাটিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের চেয়ারে বসেন আ ন ম শামসুল আলম খান।ফলে বর্তমান সংকট নিরসনে সেনাবাহিনীর শিক্ষা কোরের ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তা কিংবা সরকারি কলেজের (বিসিএস) কাউকে প্রেষণে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ করার দাবি উঠেছে সর্ব মহলে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পর্ষদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পদাধিকারবলে জেলা প্রশাসককে আহ্বায়ক করে গত ১ ডিসেম্বর একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। সেই আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদও গত ২১ জুন শেষ হওয়ায় নতুন সংকটে পা ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটি।প্রতিষ্ঠানটি এখন একরকম কাণ্ডারিবিহীন।
উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের সাধারণ শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মর্যাদা ইস্যুতে দীর্ঘদিন স্কুল ও কলেজ শাখার শিক্ষকদের সম্পর্ক দা-কুমড়া। এখানে পারতপক্ষে শিক্ষকরা কেউ কারও ছায়াও মাড়ান না। সবকিছুতেই তাঁদের মধ্যে বিরোধ। এতে প্রশাসনিক কার্যক্রমও স্থবির। এর সঙ্গে অনিয়ম-দুর্নীতি ছড়িয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটির রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ।
স্কুল ও কলেজ শাখা মিলিয়ে এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। স্কুল শাখার শিক্ষকরা দাবি করেন, স্কুল শাখায় শিক্ষার্থী বেশি হওয়ায় সেই আয় দিয়েই কলেজ শাখা চলে। অথচ কলেজ শাখা তাদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে আসে। অন্যদিকে কলেজ শাখার শিক্ষকরা জানান, প্রতিষ্ঠানপ্রধান তাঁদের থেকেই হওয়া উচিত। কারণ, বেতন স্কেলে সহকারী অধ্যাপকরাই জ্যেষ্ঠ। এখন দু’পক্ষই চাইছে, সংকট নিরসনে সেনাবাহিনীর শিক্ষা কোরের ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তা কিংবা সরকারি কলেজের (বিসিএস) কাউকে প্রেষণে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ করতে। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানের ১৪০ শিক্ষক এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে লিখিত আবেদনও করেছেন।
জানা যায়, গত ২২ ফেব্রুয়ারি নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি/ম্যানেজিং কমিটি গঠনের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড থেকে নির্বাচন দেওয়ার আদেশ থাকার পরও নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করেনি আহ্বায়ক কমিটি। কালক্ষেপণ করতে করতে গত মাসেই ওই কমিটির মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। নাম না প্রকাশ করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষক অভিযোগ করেন, আগের মতো এবারও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিশেষ কমিটির অনুমোদন এনে নিজেই ইচ্ছামতো প্রতিষ্ঠান চালানোর পাঁয়তারা করছেন।
অনিয়মই যেখানে নিয়ম : অভিযোগ রয়েছে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকা আ ন ম শামসুল আলম খান অবৈধভাবে সহকারী শিক্ষক থেকে প্রভাষক হন। এমনকি সহকারী শিক্ষক পদে ইস্তফা না দিয়েই প্রভাষক পদে যোগ দেন। এ নিয়ে ওই সময় সমালোচনা হলেও গায়ে মাখেননি তিনি। পরে প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হয়ে যান শামসুল আলম।
এদিকে, মাসের পর মাস প্রতিষ্ঠানটির চার শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়মিত বেতন না পেলেও উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের কতিপয় ব্যক্তি ঠিকই পাচ্ছেন বেতন।কেউ কেউ অতিরিক্ত বেতনও নিচ্ছেন। ক্যান্টিন ব্যবস্থাপক থেকে সহকারী শিক্ষক বনে গেছেন তারিকুল আযম খান। শিক্ষক-কর্মচারীদের ওপর ছড়ি ঘোরানোর ‘দক্ষতার পুরস্কার’ হিসেবে তাঁকে প্রশাসনিক কো-অর্ডিনেটর পদেও বসানো হয়েছে। এ জন্য প্রতি মাসে দেওয়া হচ্ছে বাড়তি সাড়ে ১০ হাজার টাকা।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর, ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এবং ঢাকা জেলা শিক্ষা কার্যালয়ে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অনিয়ম-দুর্নীতি ছাড়াও শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। শ্যামলী হোসেন, নিলুফার ইয়াসমিন, ইসমত আরা ফারুক, মাহাবুব আলম বাচ্চু, গিয়াস উদ্দিনসহ অনেকেই অবৈধভাবে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী শিক্ষক থেকে প্রভাষক হয়েছেন। মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে তাঁদের পদোন্নতি বৈধভাবে হয়নি উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি এড়াতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পরিচালনা পর্ষদকে নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। তবে অজানা কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি।
সূত্র জানায়, আইয়ুব আলী, লায়লা নূর, আতিকুর রহমান ও শারমিন রহমান অধ্যাপক পদে কর্মরত। তবে তাঁরা প্রত্যেকে প্রভাষক পদে কর্মরত দেখিয়ে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। সে সময় ডিজির প্রতিনিধির নামের মিল ও সই জাল করে এমপিওভুক্ত করানো হয়। শুধু তাই নয়, সেকশন হেড (ইংলিশ ভার্সন, মর্নিং শিফট) ইমেলদা হোসেন ও আফরোজা ইয়াসমিনের বিএড সনদ জাল। এ ছাড়া প্রভাষক আবদুল আজিজ, মাহবুব আলম বাচ্চু, গিয়াস উদ্দিন, এস এম মাসুদ (ইংলিশ মিডিয়াম) এবং সহকারী অধ্যাপক আসিফ রহমানের অন্তত একটি করে সনদ জাল বলে অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রফিকুল ইসলাম প্রথমে প্রতিষ্ঠানটিতে কো-অর্ডিনেটর হিসেবে যোগ দেন। পরে কর্তৃপক্ষকে হাত করে হয়ে যান সহকারী প্রধান শিক্ষক।একইভাবে শাখাপ্রধান উত্তম কুমার হাজরা প্রথমে নিয়োগ পান ল্যাব সহকারী হিসেবে।পরে স্কাউটে সহকারী লিডার এবং এখন তিনি সহকারী শিক্ষক। অথচ তাঁর এমপিওভুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দূরে থাক, নিয়োগপত্রই নেই।হিসাবরক্ষক আসাদুজ্জামান তুহিনের শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকায় ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ জুড়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে দুই বছর নিয়মিত শিক্ষকতার বিধি ভেঙে মাত্র সাত দিনের মধ্যে তাঁর চাকরি স্থায়ীকরণ করে কর্তৃপক্ষ।পরে তুহিনকে বেশ কয়েকটি ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্নিষ্ট শিক্ষকরা জানান, গত ১ নভেম্বর সহকারী অধ্যাপক নাসিমা চাঁদনীকে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবদুল মজিদ বর্তমান আহ্বায়ক কমিটিতে শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করে চিঠি দেন।ফয়সাল শামীম প্রভাব খাটিয়ে চাঁদনীর নাম বাদ দিয়ে পরের মাসেই শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে ফের চিঠি ইস্যু করান এবং শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে নিজের নাম যুক্ত করেন।ক্ষমতার দাপটে চাঁদনী জ্যেষ্ঠ শিক্ষক হওয়ার পরও বঞ্চিত হন।অন্যদিকে, ফয়সাল শামীম মাত্র ৯ বছর চাকরি করেই শিক্ষক প্রতিনিধি (টিআর) হয়ে যান।
জানা যায়, সম্প্রতি ৬২ শিক্ষকের পদোন্নতি হলেও মামলা করায় নিগার শারমিন নামের এক শিক্ষিকার পদোন্নতি আটকে রাখা হয়েছে।আগের গভর্নিং বডি বিধি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের চাহিদা ও প্রয়োজনে খণ্ডকালীন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয়।তবে ২০২১ সালের ৯ অক্টোবর জোর করে সে সময়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. আবুল হোসেনকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক।
যোগাযোগ করা হলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আ ন ম শামসুল আলম খান নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয় এড়িয়ে যান।তবে তিনি জানান, শিক্ষক-কর্মচারীরা যাতে দ্রুত বেতন-ভাতা পান, সে চেষ্টা তিনি করে যাচ্ছেন।
মেয়াদ শেষ হওয়া আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি ঢাকা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. শহীদুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাঁর সঙ্গে যুক্ত হওয়া যায়নি।খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।