একটি মোবাইল এক্স-রে মেশিনের ‘অকালমৃত্যু’

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি মোবাইল এক্স-রে মেশিন কেনার জন্য ২০১৩ সালের ১ ডিসেম্বর দরপত্র আহ্বান করা হয়। ২০১৬ সালের ২৯ মে রংপুর জেলার তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. হিমাংসু লাল রায় কিউ-সোর্স নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেন। কার্যাদেশ পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে মেশিনটি সরবরাহ করতে বলা হয়। সে হিসেবে ওই বছরের ২৯ নভেম্বর মেশিনটি সরবরাহ করার কথা। কিন্তু মেশিনটি সরবরাহ করা হয় দুই বছর পাঁচ মাস পর ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর। এ হিসাবে দরপত্র আহ্বানের প্রায় পাঁচ বছর পর ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনটি হাসপাতালে পৌঁছায়। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো- নতুন ওই মেশিনটি দিয়ে ১৪ জন রোগীর এক্স-রে করার পর সেটি বিকল হয়ে পড়ে। এরপর সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই মেশিনটি আর সচল করে দেয়নি। মেশিনটি বিকল থাকায় শত শত মানুষ এক্স-রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. রুহুল আমিনের এক চিঠিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. রুহুল আমিন বলেন, প্রায় এক মাস আগে সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান নিমিউ অ্যান্ড টিসি থেকে কর্মকর্তারা সরেজমিন এসে মেশিনটি দেখে গেছেন। যন্ত্রটি দ্রুত মেরামত করে দেওয়ার বিষয়ে তারা আশ্বস্ত করেছেন। তবে তিনি এখনও মেশিনটি পাননি।

শুধু পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নয়, রংপুর জেলার সাত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে আরও প্রায় ৩০ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। দুদকের তদন্তেও প্রায় ৩০ কোটি টাকা দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এক অজ্ঞাত কারণে দুদকের ওই প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া মেশিনের নাম ৫০০এমএ ডিজিটাল মোবাইল এক্স-রে মেশিন। মডেল :ডব্লিউডিআর, ব্র্যান্ড : ফিলিপস, জার্মানির এই মেশিনের মূল্য তিন কোটি ১৪ লাখ ৪৯ হাজার ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এত টাকা মূল্যের মেশিন দিয়ে মাত্র ১৪টি এক্স-রে করা সম্ভব হয়েছে বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সংশ্নিষ্টরা জানান, সোয়া তিন কোটি টাকা মূল্য দেখানো হলেও মেশিনের প্রকৃত দাম পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকার বেশি নয়। চলতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. রুহুল আমিন ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর একটি চিঠি পাঠান। ওই চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব, রংপুর বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) এবং রংপুরের সিভিল সার্জনকে। ওই চিঠিতে বলা হয়, ১৪টি এক্স-রে করার পর মেশিনটি বিকল হয়ে পড়ে। বিষয়টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কিউ-সোর্স কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। পরে ২০১৮ সালের ৬ ডিসেম্বর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হাসপাতালে পাঠায়। কিন্তু তারা মেশিনটি চালু করতে ব্যর্থ হয়। পরে রংপুর বিভাগীয় পরিচালকের মাধ্যমে ওই মেশিন মেরামতের জন্য রাজধানীর মহাখালীর নিমিউ অ্যান্ড টিসিতে পাঠানো হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু নিমিউ অ্যান্ড টিসি কর্তৃপক্ষও মেশিনটি চালু করতে পারেনি। এতে করে রোগীরা সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন। মোবাইল এক্স-রে মেশিনটি রোগীদের সেবার উপযোগী করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি অনুরোধ করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোবাইল এক্স-রে মেশিনের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি কিউ-সোর্সের মালিক মোকছেদুল ইসলাম। তিনি স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর বড় ভাই। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। স্বাস্থ্য খাতে চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে কয়েকজন ঠিকাদার ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হলেও মিঠুকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। দুদক থেকে মিঠুকে তলব করা হলেও তিনি হাজির হননি। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী মিঠু শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে দুদকে হাজির হতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বিষয়টি জানতে মোকছেদুল ইসলামকে ফোন করা হলেও তার মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। তবে একাধিক সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর মিঠুর সঙ্গে তিনিও দেশ ছেড়েছেন। তবে তিনি কোন দেশে অবস্থান করছেন, তা নিশ্চিত করতে পারেননি কেউ।

শুধু পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নয়, রংপুর জেলার সাত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটিয়েছে এই চক্র। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রংপুর সিভিল সার্জন অফিসের অধীনে সাত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়। ওই দরপত্রে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কিউসোর্সকে যন্ত্রপাতি সরবরাহের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ২৯ মে কার্যাদেশ পাওয়ার পরদিনই জার্মানি, ব্রাজিল, কোরিয়া, ইউএসএ, তাইওয়ান, পোলান্ড, চীন ও জাপানের তৈরি বিভিন্ন আইটেমের ২৪ কোটি ৮৮ লাখ ৫৪ হাজার ৯৯০ টাকার যন্ত্রপাতি সরবরাহ দেখিয়ে বিল উত্তোলন করে নেওয়া হয়। একই দরপত্রে আরও ১৭ কোটি ৫৫ লাখ ৭০ হাজার ৩০০ টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। হাসপাতাল সংশ্নিষ্টরা জানান, বড় বড় দেশের নামের স্টিকার লাগিয়ে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়।

দুদকের সহকারী পরিচালক আমিরুল ইসলাম তদন্ত করে প্রায় ৩০ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পান। ২০১৭ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও দুদকের একটি দল সেসব হাসপাতাল পরিদর্শন করে দেখতে পান, প্রায় ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি অব্যবহূত ও অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। ওই কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদনও দাখিল করেন। কিন্তু মিঠু সিন্ডিকেট ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে।

দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক আমিরুল ইসলাম অবসরে চলে গেছেন। তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

স্বাস্থ্য খাতে মিঠু যেভাবে রাজত্ব কায়েম করেন: সংশ্নিষ্টরা জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলে প্রথমেই আসবে আলোচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর নাম। স্বাস্থ্য খাতে তিনি একচেটিয়া রাজত্ব করেন। ২০০৯ থেকে ২০১৪ এই পাঁচ বছর স্বাস্থ্য খাতের শত শত কোটি টাকা লোপাটের সঙ্গে সিন্ডিকেটটির জড়িত থাকার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। ওই সময় লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ এবং লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ ও টেকনোক্রেট লিমিটেড নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া লেংকিন মার্চেন্ডাইজ, সিআর মার্চেন্ডাইজ ও এলআর এভিয়েশন, জিইএফ অ্যান্ড ট্রেডিং, ট্রেড হাউস, মেহেরবা ইন্টারন্যাশনাল, ক্রিয়েটিভ ট্রেড, ফিউচার ট্রেড, লেক্সিকোন আইটি (প্রা.) লি., টেকনো ট্রেড, বিলিয়ার এভিয়েশন, সিএসই অ্যান্ড ট্রেডিং, হ্যাভ ইন্টারন্যাশনাল, লেসিকোন হসপিটালেট, নর্থ ট্রেড নামের ঠিকাদারি ফার্মের নামে এসব হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবারহ করা হয়। লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিভিন্ন হাসপাতালের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, অফিস সহকারীদের নিয়ে গড়ে তোলেন মিঠু। যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই কোটি কোটি টাকার বিল তুলে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। রংপুরের মতো ঠিকাদার মিঠুর জাল সারাদেশে ছিল বিস্তৃত। একের পর এক হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছে এই মিঠু সিন্ডিকেট। ২০১৫ সালে আটটি হাসপাতালের দুর্নীতি অনুসন্ধানে নামে দুদক। এসব হাসপাতালের মধ্যে মুগদা ৫০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহে তিন বছরের জন্যে ৪০০ কোটি টাকার টেন্ডারের কাগজপত্র, নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি সরবরাহ সংক্রান্ত বিল-ভাউচার, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৫০০ কোটি টাকার নথি, গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালের জন্য বরাদ্দকৃত ৪০ কোটি টাকার কাগজপত্র, মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে ৩০ কোটি টাকার কেনাকাটা সংক্রান্ত তথ্য, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৬০ কোটি টাকার দুর্নীতির তথ্য, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১০ কোটি টাকার দুর্নীতির তথ্য চাওয়া হয়। এ ছাড়া যন্ত্রাংশ সরবরাহ না করেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে ২৭ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার বিবরণও চাওয়া হয়। এ কার্যক্রম শেষ না হলেও হাসপাতালগুলোতে একের পর এক বিল ছাড় করা হয়েছে। এসব হাসপাতালে সরকারি অর্থ লোপাটের ঘটনার সঙ্গে মিঠুসহ বিতর্কিত ঠিকাদারদের সংশ্নিষ্টতা পায় দুদকের অনুসন্ধানকারী দল। এ ছাড়াও বিভিন্ন হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ-সংক্রান্ত টেন্ডারের কাগজপত্রসহ যাবতীয় নথি তলব করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য খাতের কয়েকজন কর্মকর্তার নথি চাওয়া হয়। তারা হলেন- উপসচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান, অবসরপ্রাপ্ত উপসচিব আবদুল মালেক, অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষক মো. আবজাল, প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল কাফী ও সুলতান মাহমুদ। তাদের মধ্যে শুধু আবজালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেই দেশ-বিদেশে একাধিক বাড়ি রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, তদারকি ও নজরদারির মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই তার প্রধান লক্ষ্য। মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছেন। যিনি অনিয়ম-দুর্নীতি করবেন, সেই দায়ভার তার ওপরই বর্তাবে। করোনার সময় ক্রয় প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়ম-দুর্নীতিতে যারা যুক্ত ছিলেন, তারা কেউ ছাড় পাননি। সুতরাং দুর্নীতি করে কেউ পার পাবেন না। আইন অনুযায়ী তার শাস্তি নিশ্চিত করা হবে বলে জানান তিনি।

Share