কক্সবাজার প্রতিবেদক : কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে দুই তরুণীকে লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারধর, কানে ধরে ওঠবসসহ হেনস্তা করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর মোহাম্মদ ফারুকুল ইসলামকে (২৩) নামের এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ।
গতকাল শুক্রবার রাতে শহরের ভোলা বাবুর পেট্রলপাম্পসংলগ্ন এলাকা থেকে তাঁকে আটক করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি)। এরপর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে তরুণীদের হেনস্তার সঙ্গে জড়িত বাকিদের শনাক্তকরণের কাজ চালাচ্ছে পুলিশ।
আটক মোহাম্মদ ফারুকুল ইসলাম চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকার বাসিন্দা মাজেদুল ইসলামের ছেলে। তিনি মাদ্রাসাছাত্র। কয়েক বছর ধরে তিনি শহরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাহারছড়া এলাকা থাকছেন।
গতকাল পুলিশ জানায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে যে যুবককে লাঠি হাতে দেখা গেছে, তিনি আটক হওয়া ফারুকুল ইসলাম। তাঁর ফেসবুক ওয়ালেও সেদিন হেনস্তার শিকার হওয়া তরুণীর ছবি ছিল। গত বৃহস্পতিবার তিনি নিজেই ওই ছবি পোস্ট করেছিলেন।
ফারুকুলের বিভিন্ন পোস্ট বিশ্লেষণ করে পুলিশ জানিয়েছে, তিনি এবং তাঁর সঙ্গে থাকা অনেকে ১১ সেপ্টেম্বর রাতে সৈকতে নারীদের হেনস্তা করেছেন। এ–সংক্রান্ত তিনটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি ডিবি) পরিদর্শক জাবেদ মাহমুদ বলেন, গতকাল সকালে সৈকতে নারী পর্যটককে লাঠি দিয়ে মারধর ও নির্যাতনের কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি পুলিশের নজরে আসে। পরে পুলিশ ভিডিও ফুটেজ দেখে ফারুকুলকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন। রাতে তাঁকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
গতকাল সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে সৈকতে দুই তরুণীকে মারধর-ওঠবস ও হয়রানির তিনটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, তা দেখে বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক তরুণীকে কান ধরে ওঠবস করানো হচ্ছে। তাঁকে ঘিরে রেখেছেন কয়েকজন তরুণ-যুবক। বেশির ভাগ তরুণ মুঠোফোনে মারধরে ভিডিও ধারণ করছিলেন। তরুণীকে লাঠি দিয়ে মারধর করে সৈকত থেকে চলে যেতে বলা হচ্ছিল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, সমুদ্রসৈকতের চেয়ারে বসে থাকা এক তরুণীকে চার যুবক ঘিরে ধরেন। প্রথমে ওই তরুণী পরিচয় এবং কী কাজে এত রাতে একা সৈকতে অবস্থান করছেন জানতে চান যুবকেরা। জবাবে তরুণী ঘুরতে আসার কথা জানালে যুবকেরা সৈকতের সামাজিক পরিবেশ নষ্ট করার অভিযোগ তুলে ওই তরুণীকে চলে যেতে বাধ্য করেন।
আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আরেক তরুণীকে ঘিরে ধরে বেশ কিছু কৌতূহলী মানুষ। মানুষের মধ্যে লাঠি হাতে নিয়ে অবস্থান করছেন কয়েকজন যুবক। তাঁদের একজন লাঠি দেখিয়ে ওই তরুণীকে নির্দেশ দিচ্ছেন, কান ধরে ওঠবস করতে। ভয়ে ওই তরুণী ওঠবস করতে থাকেন। তখন ঘিরে থাকা লোকজন অশ্লীল ভাষা গালমন্দ করতে থাকেন।
আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, সাধারণ পোশাকে থাকা এক ব্যক্তিকে এক তরুণী কান্নারত অবস্থায় বলছেন, ‘উনি (লাঠি হাতে যুবক) আমার ফোন কেড়ে নিয়েছেন। দয়া করে ফোনটি ফেরত দিন। প্রয়োজনে মোবাইলে থাকা সবকিছু ডিলিট করে দেব।’
কক্সবাজার টুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, হেনস্তার শিকারেরা তৃতীয় লিঙ্গের। কক্সবাজারের সহকারী পুলিশ সুপার আবুল কালাম বলেন, ‘সৈকতে মধ্যে মধ্যে তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) কয়েকজন আসে। মানুষ বিরক্ত হয়। আমরা তাদের চলে যেতে বলি। হিজড়াকে মারধরের সময় সেখানে পুলিশের কেউ ছিল না। ঘটনার পর খবর পেয়ে সেখানে পুলিশ গেছে।’
তবে তরুণীরা তৃতীয় লিঙ্গের কি না, তা দেখেই বোঝা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন ‘কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের’ সদস্যসচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম। আর তৃতীয় লিঙ্গের হলেও তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিষয়টি কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তিনি মনে করেন।
এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, সৈকতে দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা ছুটে আসেন বিনোদনের জন্য। পর্যটকদের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে টুরিস্ট পুলিশ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাম দিয়ে অতি উৎসাহী কিছু যুবক সৈকতে তরুণীদের হেনস্তা করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে তরুণীদের মারধর-ওঠবস করানোর দৃশ্য দেখে দেশে মানুষ হতাশ হচ্ছেন। তরুণীরা যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ-সেটা কারও পক্ষে পরখ করা সম্ভব নয়।’
ফারুকুল ‘সমন্বয়ক নন’
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, পুলিশের হাতে আটক ফারুকুল ইসলামসহ কয়েকজন যুবক কিছুদিন ধরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক দাবি করে সৈকতে নানা তৎপরতা চালিয়ে আসছেন। ঘটনার আগে ফারুকুল ইসলাম নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে লিখেন, ‘আজ অফিস টাইম শেষ করে আবারও শুরু করব, বেহায়াপনার বিরুদ্ধে-ইনশা আল্লাহ।’ এর আগে গত বুধবার শহরের লালদীঘির পাড় এলাকায় ভাসমান যৌনকর্মীদের লাঠি নিয়ে তাড়িয়ে মারধর করার একটি ফুটেজ আপলোড করা হয়।
গতকাল দুপুর ১২টার দিকে আযম খান নামের এক ব্যক্তি নিজের ফেসবুক আইডিতে তিনটি ভিডিও ফুটেজ আপলোড করে পোস্ট দেন। তিনি লেখেন, ‘কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে শরিয়াহ পুলিশিং চালাচ্ছে স্থানীয় সমন্বয়কেরা। কোনো নারীকে একা পেলে, কারও পোশাক পছন্দ না হলে লাঠিসোঁটা দিয়ে তাদের আক্রমণ করছে। কক্সবাজার এখন আফগানিস্তান।’
তবে কক্সবাজারের সমন্বয়ক শাহেদুল ইসলাম বলেন, আটক যুবক জেলার সমন্বয়ক বা নেতৃত্ব পর্যায়ের কেউ নন। আন্দোলনে যেহেতু শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ছিল; আটক যুবকেরও অংশগ্রহণ থাকতে পারে। তবে ব্যক্তির দায়ভার সংগঠন নেবে না।