কক্সবাজার প্রতিনিধি : কক্সবাজারে ২০১৮ সালে টেকনাফ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর একরামুল হক হত্যা, সে সময় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। কারণ তখন র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘শীর্ষ মাদক কারবারি’ একরাম ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। আর পরিবারের দাবি, তাকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। তবে ঘটনাটি আলোচিত হয় একটি অডিও ভাইরালের পর। তাতে বাবার সঙ্গে একরামের মেয়ের কথোপকথন ও গুলির শব্দ তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়। এ ঘটনার বিচার চেয়ে নীরবে-নিভৃতে কাঁদছে একরামের পরিবার। স্বামী হারানোর কষ্ট চেপে দুই মেয়েকে নিয়ে দুর্বিষহ দিনানিপাত করছেন আয়েশা বেগম।
২০১৮ সালের ২৬ মে রাতে টেকনাফের কে কে পাড়া (কাইযুকখালীপাড়া) এলাকা থেকে একরামুল হককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়কে তার গুলিবিদ্ধ লাশ মেলে।
এ ঘটনার পর বিচারের দাবিতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে একরামের পরিবার। ঘটনার পর মামলা করতে গিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার বাধার মুখে পড়তে হয় বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতেও বারবার হুমকি দেওয়া হয়। কোথাও কোনো প্রতিকার না পেয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার দিয়ে রেখেছেন স্বামীহারা স্ত্রী এবং বাবাহারা সন্তানরা। আলাপে এমনটাই জানান একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম।
তিনি বলেন, ‘একদিন স্বামী হত্যার বিচার হবে—এ আশায় বুক বেঁধে আছি। কখনো হাল ছাড়িনি। সরকার পরিবর্তন হয়েছে, এখনো বিচার পাব কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।’
আয়েশা বেগম বলেন, ‘যে নারী স্বামী হারিয়েছে, সেই জানে কষ্ট কী জিনিস। ধারদেনা করে সন্তানদের নিয়ে দিন কাটছে। সাংবাদিকরা আসেন, নানা কথা বলে বক্তব্য নিয়ে যান। কিন্তু আমার কোনো আশার ফুল ফোটে না।’ তিনি আরও বলেন, দুই মেয়ের মধ্যে বড়টা এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ছোটটা এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তাদের এক চাচা পড়ালেখার খরচ দেন। বাকিটা আল্লাহর ওপরে ছেড়ে দিয়েছি।
রাগ ও ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো জানতে পারিনি কেন, কী কারণে আমার স্বামীকে হত্যা করেছে র্যাব। তিনি তো কোনো অপরাধ করেননি। কোনো মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না…। তবে এত কষ্টের মধ্যেও স্বপ্ন দেখি আমার স্বামী হত্যার বিচার হবে। যেদিন বিচার পাব সেদিন সব কষ্টই আমার কাছে তুচ্ছ মনে হবে।’ আয়েশা জানান, সরকার পরিবর্তন হওয়ায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে হত্যা মামলা করার কথা ভাবছেন।
ওই দিনের ঘটনা তুলে ধরে আয়েশা বলেন, রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাজার কমিটির মিটিংয়ে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হওয়ার পরে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় একরামকে। আমরা তার খোঁজ নিতে একবার থানায়, একবার টেকনাফে অবস্থিত ডিজিএফআই অফিসে গিয়েছি। কিন্তু কেউ কোনো তথ্য দেননি। অনেক চেষ্টার পর মোবাইল ফোনে তার (একরাম) সঙ্গে কথা হয়। মধ্যরাতে যখন আমার স্বামীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়, তখনো আমি মোবাইল সংযোগে ছিলাম। আমি তাদের অনুরোধ করেছিলাম, আমার স্বামী যদি অপরাধ করে থাকে, তবে তাকে মামলা দিয়ে থানায় দিতে। আমার আকুতিতে তাদের মন গলেনি। সেদিন থেকে আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল। আমার সন্তানরা এতিম হয়ে গেল। এখন কেউ আমাদের খবর রাখে না। ভাঙা ঘরে এতিম মেয়েদের নিয়ে কীভাবে দিন যাচ্ছে, তা একমাত্র আমার সৃষ্টিকর্তা জানে। এ কষ্ট কাউকে বোঝানোর মতো না। কেউ বুঝবেও না। তাই এসব নিয়ে কাউকে কিছু বলতে চাই না।
সংসার কীভাবে চলছে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। কষ্টে আছি, শুধু এতটুকু বললাম। আর বলেই বা কী হবে। আমার দুঃখ, বেদনা, কান্নার ভাগ তো কেউ নেবে না। শুধু আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। আমি পিতাহারা দুই মেয়েকে বলতে পারি না তাদের বাবার খুনের বিচার হবে কি না। একজন জলজ্যান্ত মানুষকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করল। আমি র্যাবের এসব কর্মকর্তার বিচার চাই। আপনারা শুধু এতটুকু লেখেন। আর আমার দুই মেয়ের জন্য দোয়া করবেন।’
২০১৮ সালের ৪ মে দেশজুড়ে ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগানে শুরু হয় মাদকবিরোধী অভিযান। এ অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন একরামুল হক। সে সময় তিনি টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। ১২ বছর ছিলেন টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি।