করোনামুক্ত ৪ দেশে সবকিছু স্বাভাবিক হলো যেভাবে

নিজস্ব ডেস্ক প্রতিবেদক : চেক প্রজাতন্ত্রের মানুষেরা এখন চাইলেই বাইসাইকেল বা হার্ডওয়ারের দোকানে যেতে পারবেন। টেনিস খেলতে পারবেন। বাধা নেই সুইমিংপুলে যেতেও। কাল খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ইস্টার উৎসব । এর আগেই সব দোকান খুলে দিতে চায় অস্ট্রিয়ার সরকার। করোনাভাইরাসে সংক্রমণের এখনকার নিম্নগতি অব্যাহত থাকলে আগামী সপ্তাহে ডেনমার্কের কিন্ডারগার্টেন এবং স্কুলগুলো খুলে দেওয়া হবে। এক সপ্তাহ পর খুলছে নরওয়ের স্কুলগুলোও।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পশ্চিমের দেশগুলোর মধ্যে এই দেশগুলোই প্রথম লকডাউন তুলে দিয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফেরানোর পথে আছে।

করোনাভাইরাসের প্রকোপে আক্রান্ত সারা বিশ্ব। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। প্রাণহানি ঘটছে হাজারো মানুেষর। এখন ইউরোপের এই দেশগুলোর কাছে থেকে অনেকেরই শেখার আছে কীভাবে এই ভয়াবহ ভাইরাসের সঙ্গে লড়েত হয়। ফিরতে হয় স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে। সিএনএনের বিশেষ প্রতিবেদনে সেই ফিরে আসার আখ্যান তুলে ধরা হয়েছে।

চেক প্রজাতন্ত্রের অ্যাথলেট ইরিনা গিলারোভার কাছে লকডাউন–উত্তর এই দিন এক বিরাট পাওয়া। ইরিনার কাছে লকডাউন থেকে মুক্ত হওয়ার অর্থ হলো প্রাগ শহরের জুলিসকা স্টেডিয়ামে গিয়ে আবার প্রশিক্ষণ শুরু করা। । গতকাল শুক্রবার সিএনএনকে অ্যাথলেট ইরিনা তাঁর আনন্দের কথা বলেছেন, ‘সত্যি বলছি। দারুণ ব্যাপার। দুই সপ্তাহ ধরে ঘরে ছিলাম। আমার কাজের গুরুত্বটা এ সময় আরও বেশি করে বুঝেছি।’

লকডাউনের যে কড়াকড়ি ছিল, তা খুবই বাস্তবসম্মত ছিল বলেই মনে করেন ইরিনা। এখন অবশ্য চাইলেই সবাই স্টেডিয়ামে যেতে পারবেন না। এর জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে ইরিনা এতে খুশি। তাঁর কথা, ‘আমি শতকরা ১০০ ভাগ নিরাপদ মনে করছি এখন।’

বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এখন ইরিনার মতো একটি দিনের প্রত্যাশা করছেন, এ নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু চাইলেই তো সবাই তা পারছে না। কঠোর নিয়ম মেনেই আজকের এই সুখের দিন।

অক্সফোর্ড বিজনেস স্কুলের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ পিটার ড্রোব্যাক বলছিলেন, যেসব দেশ এখন লকডাউন তুলে দিচ্ছে।তারা ‘খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও আশাবাদী হওয়ার উদাহরণ’ তৈরি করল আর পশ্চিমের অন্যান্য দেশের তাদের থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপের আঞ্চলিক পরিচালক ড. হ্যান্স ক্লজ এ সপ্তাহেই সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন। তাঁর কথা, ইউরোপের অবস্থা এখনও উদ্বেগজনক। আর এখন লকডাউন শিথিল করার উপযুক্ত সময় নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ কর্মকর্তার এই উদ্বেগ অমূলক নয় একেবারেই। কারণ, বিশ্বের করোনা সবেচেয়ে বেশি আক্রান্ত ১০টি দেশের মধ্যে ৭টিই ইউারোপে।

মেডিকেল জার্নাল ‘ল্যানসেট’–এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগে লকডাউন পুরো তুলে দেওয়াটা উচিত হবে না। তবে অক্সফোর্ড বিজনেস স্কুলের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ পিটার ড্রোব্যাক বলছেন, যেসব দেশ তাদের লকডাউনের কড়াকড়ি এখন উঠিয়ে নিচ্ছে সেগুলো হলো সেসব দেশ, যারা সবচেয়ে আগে এটা বাস্তবায়ন করেছিল।

আবার এসব দেশের মৃত্যুর হার অন্যান্য দেশের চেয়ে কম। সামাাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে এসব দেশ উদাহরণ তৈরি করেছে। আবার এসব দেশে করোনার টেস্ট হয়েছে ব্যাপক হারে। তারা এখন ধীরে ধীরে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করছে। আর এ জন্য সমন্বিত পরিকল্পনাও করেছে যথার্থভাবে। তারা এমনভাবে পরিকল্পনা সাজিয়েছে, যাতে নতুন করে এ রোগ ফিরে এলে তারা আবার কঠোর লকডাউনে ফিরতে পারে।

মোট তিনটি বিষয় এই দেশগুলো মেনে চলেছে, যা অন্য দেশগুলোর জন্য শিক্ষণীয়। প্রথমত, দেখার বিষয় হলো, করোনায় আক্রান্তের হার নিম্নমুখী হচ্ছে কি না। দ্বিতীয় বিষয় হলো, এসব দেশের জরুরি পরিষেবা ঠিকঠাক রাখা। আর তৃতীয় বিষয়, টেস্ট করার ব্যাপক আয়োজন করে রাখা। এ তিনের সম্মিলন ঘটেছে দেশগুলোতে। আর কিছু কিছু নিষেধাজ্ঞা তারা এখনো বজায় রেখেছে। ডেনমার্কের কথা ধরা যাক। সংক্রমণের নিম্নগতি চলতে থাকলে ১৫ এপ্রিল দেশটির স্কুল খুলবে। কিন্তু আগামী ১০ মে পর্যন্ত দেশটিতে ১০ জনের বেশি মানুষের সমাবেশ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মিট্টে ফ্রেডারিকসন ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী আগস্ট মাস পর্যন্ত সব ধরনের উৎসব ও সমাবেশ বন্ধ থাকবে।

বন্ধ থাকবে দেশটির সীমান্তও। ৫৮ লাখ মানুষের দেশটি ইউরোপের প্রথম দেশ, যারা প্রথম সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল ১৩ মার্চ। ফ্রেডারিকসন বলেছেন, ‘আমাদের দেশের অবস্থা ইতালি বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো হয়নি, কারণ আমরা প্রথম থেকেই কঠোর ছিলাম।’

ডেনামার্কের মতো কঠোর ছিল চেক প্রজাতন্ত্র। দেশটিতে ১২ মার্চ জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের দেশটির জনগণকে বাড়ি থেকে বেরুলে মাস্ক পরার নির্দেশ দেওয়া হয় সেই ১৯ মার্চ থেকে। চেক প্রজাতন্ত্রের পাশের অস্ট্রিয়ার টাইরল প্রদেশের আইস হকির স্টেডিয়াম থেকে করোনাভাইরাস ব্যাপক হারে ছড়িয়েছিল বলে মনে করা হয়। এখানেও সামাজিক দূরত্ব কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। দেশটির এখনই সবকিছু খুলছে না। অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর সেবাস্টিয়ান কার্জ বলেছেন, পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। সীমিত মাত্রায় কিছু দোকানপাট খুলে দেওয়া হলে মে মাস থেকে আরও বেশি করে খোলা হবে। নতুন করে করোনার ফিরে আসার বিষয়ে সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দেশবাসীকে শুনিয়েছেন সিবাস্টিয়ান। তিনি ধাপে ধাপে সবকিছু খুলে দেওয়ার পক্ষে। গত সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি নন, এমন ১৫০০ মানুষের করোনা টেস্ট হয়। এতে আক্রান্ত ছিল ১ শতাংশের নিচে।

২০ এপ্রিল থেকে কিন্ডারগার্টেন খুলে দেবে নরওয়ে। প্রধানমন্ত্রী এরনা সোলবার্গ এ ঘোষণা দিয়েছেন। এরপর স্কুলগুলো খোলা হবে। সোলবার্গ বলেন, ‘গ্রীষ্মের আগেই সব ছেলেমেয়ে স্কুলে ফিরবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। নরওয়ে সরকার বলছে, করোনা নিয়ে ‘সতর্ক আশাবাদ’ তাদের সৃষ্টি হয়েছে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে। দেখা যাচ্ছে, সেখানে নতুন শনাক্ত হওয়ার সংখ্যা বেশ কমছে।

নরওয়ের ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের দেওয়া তথ্য অনুুযায়ী, দেশটিতে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৬ হাাজার ২৪৪ জন মানুষের। মারা গেছে ৯২ জন।

সতর্ক আশাবাদ দেখা যাচ্ছে জার্মানিতেও। তবে দেশটির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল লকডাউনের কড়াকড়ি মেনে চলতে পিছপা না হওয়ার জন্য দেশবাসীর কাছে অনুরোধ করেছেন।

Share