করোনাকালে সুপ্রিম কোর্ট এ নেই বিচারপ্রার্থীদের পদচারণা

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান ফটকটি বন্ধ। বাতাসের দোলায় পতপত করে উড়ছে পতাকা। নীরবে দাঁড়িয়ে আছে ন্যায়বিচারের ভাস্কর্যটি। আছে সাদা দেয়ালের নান্দনিক সুপ্রিম কোর্ট ভবন, বার ভবন, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ও। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে নেই শুধু সেই আগের সব ব্যস্ততা। নেই রিট, জামিন ও সিভিল মামলা। নেই আদালতের আদেশ-নির্দেশ ও আসামি আত্মসমর্পণের তোড়জোড়। নেই কোনো আদালতের স্বাভাবিক বিচার কার্যক্রম। স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও আদালতের এমন দৃশ্য দেখেননি কেউ।

সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে প্রায় পৌনে ৬ লাখ মামলা বিচারাধীন থাকলেও বর্তমানে নেই মামলা নিষ্পত্তির ছোটাছুটি। আদালত পাড়ায় নেই আইনজীবী ও আসামিদের শোরগোল। আদালতের আঙিনাজুড়ে এখন শুধু রঙ্গন, কাঠগোলাপ, ডালিয়া ও সাদা হলুদের কোলাহল আর লাল গল্পের সমীরণ। যে মিছিলে স্লোগান ধরে দুলকি পায়ে হেঁটে চলা লাল লেজে শালিক, বুলবুলি, ফিঙ্গে আর দোয়েল পাখি। গাছ বেয়ে সঙ্গী হয়েছে কাঠবিড়ালিও। ভয়ডর যেন কিচ্ছু নেই। ওদের মাথার ওপর ঝুলছে না মামলার খাঁড়া। তাই বলে বিচার থেমে আছে, তা কিন্তু নয়। গত ১১ মে থেকে সর্বোচ্চ আদালতের দুটি বিভাগেই ভার্চুয়াল কোর্ট চলছে। হাইকোর্ট বিভাগে ১৩টি বেঞ্চ এবং আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত থেকে আদেশ-নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। তবে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে মোট ১০৪ জন বিচারপতি থাকলেও আদালতে আসেন না কেউই। আসেন না আইনজীবী। বসে না সব কোর্ট। যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় সমাগম হতো আদালত অঙ্গন। গত ২৫ মার্চ থেকে আজ অবধি প্রায় তিন মাস সেই উচ্চ আদালতে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীবিহীন।

আইনজীবীরা বলছেন, তাদের আইন পেশার জীবনে এমন দীর্ঘ দুর্যোগময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি কেউই। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘আইন পেশার ৫৩ বছরে এমন পরিস্থিতি দেখি নাই। একাত্তরেও মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সুপ্রিম কোর্ট পুরোপুরি বন্ধ ছিল না। ৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময়ও আদালত খোলা ছিল। আদালত হচ্ছে মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। এখন যে পরিস্থিতি তাতে বিচারপতি, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা জীবনের ভয়ে আদালতে আসছেন না।’ তার মতে, এ পরিস্থিতিতে কারও কিছুই করার নেই। সবই সৃষ্টিকর্তার হাতে। তিনিই আমাদের সবাইকে রক্ষা করবেন বলে জানান এই প্রথিতযশা আইনজীবী।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এএম আমিনউদ্দিন বলেন, ‘৩৪ বছর আইন পেশায় এমন মহামারি দেখিনি। সর্বোচ্চ আদালত অঙ্গনে প্রতিদিন অসংখ্য বিচারপ্রার্থী হাজির হতো। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে আদালতের স্বাভাবিক বিচার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সুপ্রিম কোর্ট এখন প্রাণহীন। আদালত ভবনগুলো খাঁখাঁ করছে। সুপ্রিম কোর্ট ভবন বন্ধ, আইনজীবী সমিতি ভবন বন্ধ, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস বন্ধ। তবে স্বল্প পরিসরে ভার্চুয়াল আদালত চলছে।’ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রত্যাশা রেখে তিনি বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস একদিন চলে যাবে। আবার সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। সবার পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে সুপ্রিম কোর্ট।

হয়তো বেশিদিন নয় আবারও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন। আবারও বসবে আদালত। শুরু হবে বিচারপতি, আইনজীবী, আইন কর্মকর্তাসহ আদালত সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর আনাগোনা। তবে প্রত্যাশার পারদে সবার প্রার্থনা শুধু এতটুকুই- অপরাধ যেন কমে যায়। অপরাধী নয়, বরং নানা রঙ্গের সান্নিধ্যে ফুটুক দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই আঙিনা। স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও এমন আদালত যে দেখেননি কেউ।

Share