নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলোতে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স বন্ধ করা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে এক প্রকার আতঙ্কে রয়েছেন বেসরকারি কলেজের সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। সরকারি বেতন-ভাতার বাইরে থাকা এ শিক্ষকরা যখন এমপিওভুক্তির দাবিতে সোচ্চার, তখনই গুরুত্বপূর্ণ কোর্স দুটি বন্ধের এমন ইঙ্গিত আসায় প্রায় ৬ হাজার শিক্ষক ও তাদের পরিবারের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির বক্তব্য হলো, পর্যায়ক্রমে কলেজ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স তুলে দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে তার যুক্তি হলো, যে কয়টি কলেজে খুব দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু আছে, যেখানে মানসম্পন্ন শিক্ষক আছে, সে কলেজগুলোতে রেখে বাকি সব কলেজে অনার্স-মাস্টার্স তুলে দিয়ে শুধু ডিগ্রি পাস কোর্স থাকবে আর ছোট ছোট অনেক শর্ট কোর্স চলবে, ডিপ্লোমা কোর্স চলবে। যেগুলো দক্ষতানির্ভর, পুরোপুরি কর্মমুখী হবে। যাতে শিক্ষার্থীদের চাকরি বা আত্মকর্মসংস্থান হবে। মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর থেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে।
অন্যদিকে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে জানান, ‘অনার্স-মাস্টার্স কোর্স বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। শিক্ষিত বেকার যাতে তৈরি না হন, শিক্ষার্থীরা যদি উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে চান, অনার্স-মাস্টার্স করতে চান, তাদের এই কোর্সের পাশাপাশি অন্যান্য পেশাগত কোর্স করার ওপর জোর দেওয়ার কথা আমরা বলছি।’
এদিকে অনার্স-মাস্টার্স কলেজগুলোতে ডিপ্লোমা ও শর্ট কোর্স চালু করতে কৌশল নির্ধারণে কাজ করছে ১৪ সদস্যের কমিটি। এ কমিটির কেউ কেউ অনার্স কোর্স বন্ধের পক্ষে নন। বলা হচ্ছে, বন্ধে গুরুত্ব নয়, গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কলেজে ডিপ্লোমা কোর্স চালুর। অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালুর পাশাপাশি যদি শর্ট কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স চালু হয়, তাহলে বন্ধ হলো কোথায়?
কৌশল নির্ধারণী কমিটির সভাপতি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান বলেন, অনার্স মাস্টার্স কোর্স বন্ধ করাকে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি না। শর্ট কোর্স বা ডিপ্লোমা চালুর বিষয়টি প্রাধান্য দিচ্ছি। অনার্স কোর্স ধরে রেখে তার গুণমান ধরে রাখা হবে। তবে অনার্স কোর্স সীমিত করার কথাও বলেন তিনি।
কী করছে কমিটি : কমিটির সদস্য ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অধ্যাপক ড. মো. নাসির উদ্দিন বলেন, কমিটি ২৭টি ডিসিপ্লিনের মধ্যে থেকে ১০টি ডিসিপ্লিনের ওপর কাজ করছে। বাছাই করা কলেজগুলোতে এসব ডিসিপ্লিনের ওপর ডিপ্লোমা/শর্ট কোর্স চালু করা হবে। এই কোর্স চালু হবে ডিগ্রি পাস/অনার্স স্তরের পড়াশোনা শেষে। সংশ্লিষ্ট সেক্টরের বিশেষজ্ঞদেরও এই কাজে যুক্ত করা হচ্ছে। তাদের নিয়েই সিলেবাস, কারিকুলাম তৈরি হবে। ডিপ্লোমা কোর্সের বা শর্ট কোর্স পরিচালনার সামর্থ্য আছে, শুধু সে কলেজেই এসব ডিসিপ্লিনের কোর্সগুলো চলবে।
অবশ্য কমিটির অন্য এক সদস্য বলেন, গ্রামে অনেক অনার্স-মাস্টার্স কলেজ রয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাতে গোনা। এসব কলেজে অনার্স-মাস্টার্স চালুর প্রয়োজন নেই। কোনো কোনো কলেজের মানও নেই। নেই অবকাঠামো সুবিধাও। এসব কলেজগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। এসব কলেজে অনার্স মাস্টার্স বন্ধ করা হবে।
এমপিওভুক্তির দাবিই কাল হলো! : বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফোরামের সভাপতি নেকবর হোসেন বলেন, ২৮ বছর ধরে কোর্সগুলো চলছে। বন্ধ করার বিষয়ে কোনো আলোচনা ছিল না। কিন্তু আমরা যখনই এমপিওভুক্তির দাবির জন্য সোচ্চার হলাম, তখনই অনার্স -মাস্টার্স কোর্স বন্ধের বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরা হলো। এটা অমানবিক। কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু রেখে এমপিওভুক্তির দাবি জানান তিনি।
তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, ‘কোনো কোনো কলেজে অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয় না। যে শিক্ষক বেতন পান না, তিনি ক্লাসে কী পড়াবেন? তখন চিন্তা করা হলো, এভাবে কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি করে ভালো মানের শিক্ষা যদি দিতে না পারি, তার বদলে শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি পড়ুক। তারপর কিছু শর্ট কোর্স ও ডিপ্লোমা কোর্স চালু করে দেব। যাতে চাকরি পাওয়া সহজ হয়।’
শিক্ষকদের কী হবে : এনিয়ে বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের অনিশ্চয়তা কাটছে না। যদিও শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, এসব শিক্ষকদের কেউ চাকরি হারাবেন না। এসব শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলেছেন মন্ত্রী। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, এই কমিটির শিক্ষকদের বেতন-ভাতার বিষয়ে কিছু বলা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো এক্তিয়ার নেই। তিনি জানান, কলেজগুলোতে যখন অনার্স-মাস্টার্স কোর্স অনুমোদন দেওয়া হয় তখন শর্ত দেওয়া হয়েছিল যে, এমপিওভুক্তি দাবি করতে পারবে না। বেতন-ভাতা কলেজ পরিশোধ করবে। এখন দাবি করার মাধ্যমে তারা শর্ত ভঙ্গ করছেন। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, এদের বেতন-ভাতার দেখার দায়িত্ব জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়।
প্রসঙ্গত, বেসরকারি কলেজে ১৯৯৩ সাল থেকে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সের অনুমোদন দেওয়া হয়। দেশে এখন ৩১৫টি বেসরকারি কলেজে এ কোর্স চালু আছে। এসব কলেজে ৬ হাজারের মতো শিক্ষক আছেন। আর শিক্ষার্থী আছে ৭ লাখের বেশি।