গজারিয়া কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করায় ধন্যবাদ

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : চীন সরকারের সাথে ২০১৬ সালে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক থেকে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় নির্মাণাধীন ৩৫০ মেগাওয়াটের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে জানানো বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক অনুরোধ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি তৈরি করা হলে ওই অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে, এমন বিষাক্ত দূষণ সম্পর্কে স্থানীয় মানুষের উদ্বেগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই প্রকল্প বাতিল করায় আমরা রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই।

মেঘনা নদীর তীরবর্তী এই জায়গায় আমদানি করা কয়লা সরবরাহজনিত জটিলতার বিষয়ে আরপিসিএল-এর মূল্যায়নকে বাপা সঠিক মনে করে। এর ফলে নোংরা কয়লা দূষণ থেকে মেঘনা নদীটিকে বাঁচানোর পাশাপাশি প্রায় তিন হাজার ছয়শ কোটি টাকার এই কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ না করায় কয়লা আমদানির লক্ষ লক্ষ টাকা সাশ্রয় করা হবে এবং কয়লার অভাবে এত ব্যায়বহুল প্রকল্পের উৎপাদন ব্যাহত হবে না। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উদ্ভূত বাণিজ্য ঘাটতি কমাতেও এই সিদ্ধান্ত ভূমিকা রাখবে।

গাজারিয়া কয়লা প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক উভয়ভাবেই একটি সুবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত। আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের প্রশংসা করি এবং সারাদেশে আরও কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প বাতিল করার আহ্বান জানাই।

বাপা বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণ পর্যালোচনা করে দেখেছে যে, যেসকল অঞ্চলে বায়ু দূষণের পরিমাণ বেশি, সেই সমস্ত জায়গায় করোনা ভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। যেহেতু কয়লা প্রকল্পসমুহ সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, পার্টিকুলেট ম্যাটার, পারদ এবং ছাইসহ বিষাক্ত বায়ু দূষণকারী উপাদান নিঃসরণ করে, সেহেতু কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্টজনিত রোগ ছাড়াও স্ট্রোকের ঝুঁকি, ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, হাঁপানি এবং ফুসফুসের নানাবিধ সংক্রমণ আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে যায়।

কয়লা দূষণ হাজার হাজার মানুষের অকালমৃত্যুর কারণ। যেহেতু করনা ভাইরাস ফুসফুসে আক্রমণ করে এবং বাংলাদেশ পাওয়ার সিস্টেম প্ল্যানে প্রস্তাবিত ২৯টি কয়লা প্লান্টের বেশিরভাগ এখনো নির্মাণ করা হয়নি, তাই পরিকল্পিত সকল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করলে তা হবে লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য একটি কল্যাণকর পদক্ষেপ। কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যখন ব্যাপক মন্দার দিকে এগিয়ে চলেছে, তখন আমদানি নির্ভর কয়লা প্রকল্প তৈরি করতে বিদেশি সংস্থাগুলির সাথে শতশত কোটি টাকার চুক্তি সম্পাদন দেশের অর্থনীতির জন্য চরম অকল্যাণকর।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, আরপিসিএল পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়, গজারিয়া কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে সাড়ে সাত গুণ বড় পটুয়াখালী কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার প্রস্তাব করেছে। যেহেতু পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২০২০ সালের পর উৎপাদনে আসলে বিদ্যুৎ সরবরাহের পূর্বাভাস অনুযায়ী ওই বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত গ্রাহক থাকার কথা নয়, তাই পটুয়াখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করা অর্থনৈতিকভাবে একটি যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত হবে। উপরন্তু, করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেবার পর, ইতিমধ্যে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার পোশাক তৈরির কার্যাদেশ বাতিল হয়েছে এবং ১ কোটিরও বেশি পোশাকশিল্পের শ্রমিক হতাশ হয়ে পড়েছে। ফলে বিদ্যুতের চাহিদা ভবিষ্যতে নাটকীয়ভাবে হ্রাস পাবে। কাজেই পায়রা এলাকায় আরপিসিএল-এর পটুয়াখালী কয়লা কেন্দ্র নির্মাণের কোন প্রয়োজন আর এখন নেই।

বাপা, গাজারিয়া প্রকল্প বাতিল করার পাশাপাশি কালাপাড়ার পটুয়াখালী কয়লা প্রকল্পটিও বাতিল করার বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য আরপিসিএলকে উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাপা জাতীয় পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ওয়াহিদুদ্দিন মাহমুদ বলেন, “বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই মধ্যবয়েসীদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, যে রোগগুলির জন্য পরিবেশ দূষণকে দায়ী মনে করা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে, কোভিড-১৯ জনিত কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি শ্বাসকষ্ট রোগে আক্রান্তদের ক্ষেত্রেই বেশি; সেজন্য জনস্বাস্থ্যের উপর কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিরূপ প্রভাব এখন আরও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর সামাজিক লাভ-ক্ষতির পূনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন, এবং তা ভবিষ্যতের জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি, বাস্তবসম্মত বিদ্যুৎ চাহিদার প্রাক্কলন ও জ্বালানীর বিকল্প উৎসের সম্ভাবনার বিচারেই করতে হবে।

২৬৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পটুয়াখালী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প কলাপাড়ায় অবস্থিত পায়রা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঠিক পাশেই নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফলে এটি ওই এলাকায় ব্যাপক বায়ুদূষণের সূত্রপাত করবে যা ভবিষ্যতে কোভিড -১৯ অথবা এই জাতীয় শ্বাসযন্ত্রের রোগের প্রকোপ মারাত্নকভাবে বৃদ্ধি করবে।

বাপার সভাপতি সুলতানা কামাল বলেন, “সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ সত্য হলো, পটুয়াখালি কয়লা প্রকল্প বাতিল করার ফলে এর কারণে অবশ্যম্ভাবী স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে ছিল এমন অসংখ্য প্রাণ রক্ষা পাবে। এছাড়াও এই বাতিলকরণ বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মকে কোভিড-১৯ সংকট উত্তরণে জয়ী হতে এবং ভবিষ্যতে অনুরূপ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সুযোগ অবারিত করে দেবে।

Share