নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে ‘দিল্লি জার্নাল অব অফথালমোলজি’ নামের চোখের স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকীতে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী ৪৫ জনের ওপর গবেষণাটি করা হয়। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১৪ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ছিল বেশি।
‘বাইনোকুলার ভিশন অ্যানোম্যালিস ইন চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়াং অ্যাডাল্টস অ্যান্ড ইফেকটিভনেস অব ভিশন থেরাপি’ শিরোনামের গবেষণায়, মাথাব্যথা, চোখব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখার মতো উপসর্গ নিয়ে আসা ব্যক্তিদের (নমুনা) হাসপাতালটির ভিশন থেরাপি ক্লিনিকে পাঠানো হয়। ক্লিনিকে বাইনোকুলার ভিশন (বিভি) পরীক্ষা করা হয়। অর্থাৎ, ব্যক্তি তার দুই চোখে একসঙ্গে একই সময়ে স্পষ্ট ও নিখুঁতভাবে দেখতে পায় (ডেপথ পারসেপশন বা থ্রিডি) কি না, তা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় ৪৪ জনের, অর্থাৎ প্রায় ৯৮ শতাংশের বাইনোকুলার ভিশন অ্যানোম্যালিস (বিভিএ) শনাক্ত হয়। বিভিএ শনাক্ত হওয়া ৪৪ জনকে প্রথমে বাসায় এক মাসের থেরাপি নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তারপরও যাদের সমস্যা দূর হয়নি, তাদের হাসপাতালটির ক্লিনিকে কয়েকটি অধিবেশনে থেরাপি দিয়ে এক মাস পর আবার বিভি পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় দেখা যায় অধিকাংশের সমস্যা দূর হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, ৪৪ জনের মধ্যে ৩৬ জন, অর্থাৎ প্রায় ৮২ শতাংশের মাথাব্যথা, চোখব্যথা, এক জিনিস দুটো করে দেখা, চোখে ঝাপসা দেখা ইত্যাদি সমস্যা দূর হয়েছে। বাকি ১৮ শতাংশের সমস্যা পুরোপুরি দূর হয়নি। বিভিএ শনাক্ত হওয়ার পর কারও চশমার প্রয়োজন হয়েছিল, কারও হয়নি বলে গবেষণার ফলাফলে উল্লেখ করা হয়।
গবেষণাটিতে নেতৃত্ব দেন হাসপাতালটির শিশুচক্ষুরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. মোস্তফা হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাথাব্যথা, চোখব্যথার সমস্যা বললে অনেক সময়ই মাইগ্রেন বলে ভাবা হয়। এ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা হয় না। চোখ পরীক্ষার সময় চার্টের নিচের লাইন পড়তে পারলেই মনে করা হয়, সব ঠিকঠাক আছে। অনেক শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায়, চোখব্যথা-মাথাব্যথার কারণে তারা ঠিকভাবে পড়াশোনা করতে পারছে না। স্কুলে বোর্ড থেকে তারা খাতায় ঠিকঠাকভাবে লেখা তুলতে পারছে না। তাঁরা দেশে প্রথমবারের মতো ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভিশন থেরাপি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে রোগটি (বিভিএ) শনাক্তের উদ্যোগ নেন। থেরাপির মাধ্যমে রোগটি ভালো করার ক্ষেত্রে তাঁরা সফলতা পেয়েছেন। শুধু চশমা দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হয় না।
বিভি ত্রুটি : এক মাস আগে ক্লাস করার সময় হঠাৎ চোখে এক জিনিস দুটো দেখা শুরু করে ময়মনসিংহের নান্দাইলের স্কুলছাত্রী সামিয়া রশিদ। পরে সহপাঠীর সহায়তা নিয়ে তাকে স্কুল থেকে বাসায় পৌঁছাতে হয়। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধে খেয়ে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। কিন্তু দশম শ্রেণির এই ছাত্রীর মাথাব্যথা ও চোখব্যথার সমস্যা রয়েই যায়। পাশাপাশি তার চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
উন্নত চিকিৎসার জন্য সামিয়াকে রাজধানীর ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল নিয়ে আসেন তার বাবা মো. হারুনুর রশিদ। ২ এপ্রিল হাসপাতালের ভিশন থেরাপি ক্লিনিকে বাবা-মেয়ের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। বাবা জানান, এ সমস্যার কারণে এক মাস ধরে তাঁর মেয়ে স্কুলে যেতে পারছে না। ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারছে না।
হাসপাতালটির ভিশন থেরাপি ক্লিনিকের অ্যাসোসিয়েট অপ্টোমেট্রিস্ট মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে সাধারণভাবে সামিয়ার চোখ পরীক্ষা করা হয়। পরে ভিশন থেরাপি ক্লিনিকে পরীক্ষা হয়। পরীক্ষায় তার বিভি ত্রুটি (বাইনোকুলার ভিশন অ্যানোম্যালিস—বিভিএ) শনাক্ত হয়। এখন তাকে থেরাপি দেওয়া হয়েছে।
একই দিন (২ এপ্রিল) অভিভাবকের সঙ্গে গাজীপুর থেকে ভিশন থেরাপি ক্লিনিকে এসেছিল স্কুলছাত্রী সারিকা রোজারিও। তারও বিভিএ শনাক্ত হয়। সারিকা প্রথম আলোকে বলে, সে দেড় বছর ধরে মাথাব্যথার সমস্যায় ভুগছে। তবে আগে চিকিৎসক দেখায়নি।
ভিশন থেরাপি ক্লিনিকের মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বাসায় কীভাবে থেরাপি নিতে হবে, তা সারিকাকে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক মাস পর তার কোনো উন্নতি হয়েছে কি না, তা দেখা হবে।
৩ এপ্রিল আল কামা (১০) নামের এক ছেলেশিশুকে নিয়ে পাবনা থেকে ভিশন থেরাপি ক্লিনিকে ফলোআপ চিকিৎসা নিতে আসেন মা হাসিনা পারভীন ও খালা নাজমা খাতুন। নাজমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাগনের চোখ সব সময় পানিতে টলমল করত। এক জিনিস দুটো করে দেখত। দীর্ঘদিন বাসায় থেরাপি দেওয়ার পর সমস্যাগুলো দূর হয়েছে। তবে চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার চোখে সামান্য কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। তার চশমার পাওয়ার পরিবর্তন হয়েছে।
দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন : হাসপাতালটির শিশুচক্ষুরোগ বিভাগের প্রধান মোস্তফা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বস্তু এক চোখে দেখা আর দুই চোখে দেখার মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। দুই চোখে একসঙ্গে একই জিনিস দেখার বিষয়টি (ডেপথ পারসেপশন বা থ্রিডি) অনেকের নেই বা কম আছে। যাদের নেই, থেরাপির মাধ্যমে তাদের অনেকের তা ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। যাদের কম আছে, তাদের অনেকের থেরাপির মাধ্যমে তা বাড়ানো সম্ভব। এতে মাথাব্যথা, চোখব্যথা, এক জিনিস দুটো করে দেখা, চোখে ঝাপসা দেখা, শিখন সমস্যা ইত্যাদি ভালো হয়। এই রোগের ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।
মুঠোফোন-ট্যাবের ব্যবহার কমাতে হবে : চোখব্যথা, মাথাব্যথা বা দৃষ্টিত্রুটি প্রতিরোধে মোস্তফা হোসেনের পরামর্শ হলো, কম্পিউটার, ট্যাব, মুঠোফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতি ২০ মিনিট অন্তর চোখে বিরতি দিতে হবে। শিশুদের দীর্ঘ সময় মুঠোফোন, ট্যাব ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না। বিছানায় বা সোফায় শুয়ে পড়াশোনা করা যাবে না। চেয়ার-টেবিলে সোজা হয়ে বসে দূরত্ব রেখে পড়তে হবে। ঘরবন্দী হয়ে সারাক্ষণ পড়ালেখা করা যাবে না। ঘরের বাইরে বা ছাদে খোলা হাওয়ায় কিছুক্ষণ ঘুরতে হবে। পাশাপাশি ভিটামিন ‘এ’–যুক্ত খাবার, ফল, ছোট মাছ, সবুজ শাকসবজি খেতে হবে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বিভি ত্রুটি শনাক্তে তারা ২০২০ সালে ভিশন থেরাপি ক্লিনিক স্থাপন করে। ২০২১ সালে ৪৩৮, ২০২২ সালে ২ হাজার ৭০৬ ও চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৮৫৩ জন রোগী ক্লিনিকে এসেছে।
হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এ কে এম আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এই হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে আড়াই হাজার রোগী দেখা হয়। চোখের চিকিৎসায় আধুনিক ও নতুন যা কিছু আবিষ্কার হয়, তা হাসপাতালে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ভিশন থেরাপি ক্লিনিক তেমনই একটি উদ্যোগ।