নয়াবার্তা প্রতিবেদক : এক বছরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হারে চালের উৎপাদন বাড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশে। বিদায়ী বছরের (২০২২-২৩) চেয়ে নতুন বছরে (২০২৩-২৪) উৎপাদন বাড়তে পারে ১ দশমিক ৮ শতাংশ। আর মোট চালের উৎপাদনে চীন ও ভারতের পর তৃতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে প্রকাশ করা গ্লোবাল ফুড আউটলুক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উৎপাদনের পরিমাণ পূর্বাভাসের তুলনায় কম হওয়ায় বিশ্বের অন্যতম চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত ও পাকিস্তান এ বছর রপ্তানি কমাতে বাধ্য হয়েছে। ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডকেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম রপ্তানি করতে হবে। ভারত গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় ৪০ লাখ টন চাল কম রপ্তানি করবে।
অন্যদিকে উৎপাদন কম হওয়ায় বাংলাদেশকে দুই বছর আগেও ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করতে হয়েছিল। কিন্তু এ বছর উৎপাদন ভালো হওয়ায় বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ কমে আট লাখ টনে নেমে এসেছে। জুলাই থেকে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের জন্য প্রকাশ করা ওই প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘের এই সংস্থা প্রতি ছয় মাসের জন্য একবার করে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। তাতে বাংলাদেশে গমের উৎপাদনও এক লাখ টন বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
গ্লোবাল ফুড আউটলুক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চীন চাল উৎপাদনে এখনো শীর্ষে রয়েছে। গত বছর দেশটিতে উৎপাদিত হয়েছে ১৪ কোটি ২৮ লাখ টন। আগামী বছরে (২০২৩-২৪) উৎপাদন দাঁড়াতে পারে ১৪ কোটি ৩৪ লাখ টন। উৎপাদন বৃদ্ধি হতে পারে দশমিক ৪ শতাংশ। এরপর রয়েছে ভারত। গত বছর দেশটির উৎপাদিত হয়েছে ১৩ কোটি ৮ লাখ টন। আগামী বছরে উৎপাদন দাঁড়াতে পারে ১৩ কোটি ১০ লাখ টন। উৎপাদন বৃদ্ধি হতে পারে দশমিক ১ শতাংশ। এরপরই রয়েছে বাংলাদেশ। বিদায়ী বছরে দেশটির উৎপাদন ৩ কোটি ৮৩ লাখ টন। আগামী বছরে উৎপাদন দাঁড়াতে পারে ৩ কোটি ৮৯ লাখ টন। উৎপাদন বৃদ্ধি হতে পারে ১ দশমিক ৮ শতাংশ। একই সময়ে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে উৎপাদন বাড়তে পারে ১ শতাংশ। ভিয়েতনামে যা হতে পারে দশমিক ৩ শতাংশ।
চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি ও খাদ্যবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ থেকে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ‘গ্রেইন: ওয়ার্ল্ড মার্কেট অ্যান্ড ট্রেড’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যগুলোর উৎপাদন বেড়ে যাওয়া নিয়ে একই চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গত এক বছরে চালের উৎপাদন মোট সাড়ে সাত লাখ টন বেড়েছে। ফলে চালের আমদানি কমেছে। ২০২০-২১ সালে যেখানে বাংলাদেশ ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করেছে, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা আট লাখ টনে নেমে এসেছে। ডলার-সংকটসহ নানা অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে বাংলাদেশ এই পরিস্থিতিতে কিছুটা হলেও খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে স্বস্তিতে আছে।
জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বাংলাদেশ খাদ্য নিয়ে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। ধান কাটার ক্ষেত্রে সরকার যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর ফলে এবং নতুন উদ্ভাবন করা প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু জাতগুলো জনপ্রিয় হওয়ায় উৎপাদন বেড়েছে। এ ছাড়া কৃষি খাতে সরকারের ভর্তুকি অব্যাহত থাকায় উৎপাদন খরচ আমরা খুব একটা বাড়তে দিইনি। যার সুফল এখন পাচ্ছি।’
ইউএসডিএ চলতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বাংলাদেশের বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলনের তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এ বছর ২ কোটি ১০ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদিত হয়েছে। এতে বাংলাদেশে মাঝারি চালের দাম গত এক মাসে ২ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। কিন্তু মোটা ও সরু চালের দাম কমেনি। আর আটার দামও বাড়তির দিকে আছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বিশ্লেষণ করে ইউএসডিএ বলছে, বাংলাদেশে গত মে মাসে মাঝারি চালের কেজি ৫৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। আর মোটা চাল ৫০ টাকা ও সরু চাল ৭৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আটার দাম এখনো বেশি। প্রতি কেজি খোলা আটা ৫৮ টাকা ও প্যাকেটজাত ৬৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আর ময়দা খোলা ৬৫ ও প্যাকেটজাত ৭৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
ইউএসডিএর বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সাল থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে গমের দাম বেড়ে যায়। এতে বাংলাদেশে আমদানি কমে যাওয়ায় আটার দাম বাড়ে। ফলে সাধারণ মানুষ আটার বদলে ভাত খাওয়ার দিকে বেশি ঝোঁকে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মানুষ চাল খাওয়ার পরিমাণ বছরে ১৫ লাখ টন বাড়িয়েছে।
বোরোতে বাম্পার ফলনের পরও মোটা চালের দাম না কমার কারণ জানতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। দুটি প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা একই মতামত দেন। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশে এক যুগ ধরে মোটা চালের উৎপাদন কমছে। আর মাঝারি চালের উৎপাদন বাড়ছে। মাঝারি মানের চালের চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং মোটা চালের চাহিদা কমে যাওয়াকে কারণ হিসেবে মনে করছেন তাঁরা।
বাংলাদেশে খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা মানুষজন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পুষ্টিকর খাবারের পেছনে ব্যয় কমিয়েছে। আর ভাতের জন্য ব্যয় বাড়িয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বাংলাদেশে গত অর্থবছরে প্রায় চার কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে বোরোতে ২ কোটি ১০ লাখ টন। এর মধ্যে মোটা চাল প্রায় ৬০ লাখ টন। আর সরু ও মাঝারি চালের পরিমাণ দেড় কোটি টন। ধারাবাহিকভাবে মাঝারি চালের উৎপাদন বাড়ছে। গত এক যুগে দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত ধানের নতুন জাত থেকে বেশির ভাগই মাঝারি মানের চাল আসছে। বিশেষ করে বোরোতে দেশে বর্তমানে ৫০ জাতের ধানের চাষ হয়। এর মধ্যে মাঝারি জাতের বিআর-২৮ ও ব্রি-২৯ থেকে আসে ৪০ শতাংশ চাল।
ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবির বলেন, ‘মাঝারি মানের চাল হয় এমন ধানের নতুন জাতগুলো দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। এগুলোর উৎপাদনও বেশি। কৃষকেরা দামও ভালো পান। যে কারণে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন দ্রুত বাড়ছে। কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ আরও বেশি ভাতের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। তাই আমরা জিংক, ভিটামিন ও পুষ্টিসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবনে মনোযোগ দিচ্ছি।’
যন্ত্রনির্ভরতা বাড়ায় উৎপাদন বৃদ্ধি : দেশের কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশে গত এক যুগে কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। বিশেষ করে করোনাকালে এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ইতিবাচক কিছু প্রভাবও দেশের কৃষি খাতে পড়েছে। দেশে চাল ও গমের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষক ও উদ্যোক্তারা এই খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন। ফলে সেখানে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সাত্তার মণ্ডলের হিসাবে, বাংলাদেশে ধান উৎপাদনের পাঁচটি ক্ষেত্রের মধ্যে অন্তত তিনটিতে প্রায় শতভাগ যন্ত্রনির্ভর হয়ে গেছে। এর মধ্যে জমি তৈরিতে পাওয়ার টিলারের ব্যবহার, জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য যন্ত্রচালিত ক্ষুদ্র সেচযন্ত্র এবং ধানমাড়াই যন্ত্রের ব্যবহার প্রায় শতভাগ হয়ে গেছে। এর বাইরে ধান কাটার ক্ষেত্রে কম্বাইন হারভেস্টারের ব্যবহার ২৫ শতাংশ ও নিড়ানির ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ কাজ যন্ত্র দিয়ে করা হচ্ছে, যে কারণে বাংলাদেশে ফসলের উৎপাদন দ্রুত বাড়ছে।
সাত্তার মণ্ডল বলেন, তবে মাঝারি ও সরু চালের জাত উদ্ভাবন এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খাতে বিনিয়োগ ও মনোযোগ আরও বাড়াতে হবে। আর অতিদরিদ্র মানুষের জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে।