নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে একটি থিম সং তৈরি করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এই ‘থিম সং’ আহ্বান করা হয়েছে। এটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচন করা হবে।
গতকাল ২৭ এপ্রিল মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, থিম সংটি অবশ্যই একটি পূর্ণাঙ্গ গান হতে হবে। যে কোনো সুরকার, গীতিকার এবং শিল্পী সম্মিলিতভাবে অথবা যে কেউ এককভাবে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবেন। থিম সংয়ে অবশ্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং সমাজে ও দেশে অবদানের বিষয় উল্লেখ বা আভাস থাকতে হবে।
এতে বলা হয়, থিম সংটি আগামী ৩১-০৫-২০২১ তারিখের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিস, প্রশাসন-৩ শাখায় জমা দিতে অথবা reg.admin3@du.ac.bd এই ই-মেইলে পাঠাতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ও বর্তমান
নিজস্ব ডেস্ক প্রতিবেদক : ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পূর্ব বাংলার মানুষের উচ্চশিক্ষার দ্বার উম্মোচিত হতে শুরু করে। যদিও কাজটি মোটেই নির্বিঘ্ন ছিল না বরং নানাবিধ বাধা-প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। সূচনালগ্নে বিভিন্ন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীদের দ্বারা কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় ঢাবি ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল।
কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শাসকগোষ্ঠীর উপর্যুপরি ব্যর্থতা ও নেতিবাচক রাজনীতির কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অতীত গৌরব হারাতে শুরু করেছে। মূলত ঔপনিবেশিক শাসনামলে স্বাধীন জাতিসত্তার বিকাশের লক্ষ্যে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এবং এক সময় তা বাস্তবতাও পেয়েছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই অতীত গৌরব রক্ষা করা সম্ভব হয়নি
ঔপনিবেশিক শাসকদের অন্যায্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতিবাদের ফসল হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। বস্তুত, বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সে সময় পূর্ববঙ্গ শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনীতিসহ সকল ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে এ অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হলেও মহল বিশেষের তা পছন্দ হয়নি। ফলে নানা অজুহাতে বঙ্গভঙ্গ রদের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত তারা সফলতাও লাভ করে। যা পূর্ববঙ্গের মানুষকে সংক্ষুব্ধ করে তোলে। ফলে পূর্ব বাংলার সংক্ষুব্ধ মুসলমানদের কিছুটা শান্ত করার জন্যই ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যায় প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হয়। যা ‘গরু মেরে জুতা দান’ সমতূল্য।
মূলত ১৯০৫ সালে ‘বাংলা প্রেসিডেন্সি’ ভাগ করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন এক প্রদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। যা বঙ্গভঙ্গ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের এই সময়টা ছিল খুব অল্প সময়ের জন্য। আর এর মধ্যেই পশ্চিম বঙ্গের প্রভাবশালীরা প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন বঙ্গভঙ্গ রদের দাবিতে। এদিকে মুসলমান নেতারা নতুন প্রদেশ হওয়াতে শিক্ষাসহ নানা সুবিধা পাবেন এই আশায় উজ্জীবিত ছিলেন। কিন্তু গোটা ভারতবর্ষে কায়েমী স্বার্থবাদীদের বিরোধিতার মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়।
মহলে বিশেষের প্রবল আপত্তি ও আন্দোলনের মুখেই ১৯১১ সালে কোম্পানী সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করে। এরপর পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের ক্ষোভ প্রশমনে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জোরালো দাবি ওঠে। এতেও বঙ্গভঙ্গ বিরোধীরা বাধ সাধে। ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে ঢাকা সফর শেষে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করলে ১৯১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাৎ এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন? শেষ পর্যন্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির বিনিময়ে তার বিরোধিতার অবসান করেছিলেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ কমে যাবে এবং মুসলমানরা শিক্ষা-দিক্ষায় অগ্রসর হবে-এই আশঙ্কায় পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিজীবীদের বৃহৎ একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন বলে জানা যায়।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতার অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘শ্রেণিস্বার্থে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন লর্ড কার্জনের ওপর অতি ক্ষুব্ধ। কার্জনের উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত মন্তব্যের তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কলকাতার হিন্দু সমাজে। তাতে রবীন্দ্রনাথও অংশগ্রহণ করেন’।
এ প্রসঙ্গে গবেষক তৌহিদুল হকের বক্তব্য বেশ প্রণিধানযোগ্য। তার ভাষায়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে তিন শ্রেণীর মানুষ বিরোধিতা করেছিলেন তাদের মধ্যে আমরা রবীন্দ্রনাথকে তৃতীয় কাতারে রাখতে চাই। কারণ তারা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের উচ্চবর্ণের কিছু হিন্দু সমাজ। তাঁদের সাথে বিশেষ করে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সাথে রবীন্দ্রনাথের একাধিকবার বৈঠক, আলোচনা হয়েছে … …’।
কোলকাতার এলিট শ্রেণি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন তা খুবই স্পষ্ট। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আবশ্যকতা রয়েছে সেটা বোঝাতে এবং প্রতিষ্ঠার ব্যাপার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন অনেকেই। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। কিন্তু ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহের মৃত্যু হলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্যোগের হাল ধরেন। অন্যান্যদের মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হক উল্লেখযোগ্য। সে ধারাবাহিকতায় ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এর মাত্র তিন দিন আগে ভাইসরয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়ে ছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৗধুরী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সহ মুসলিম নেতৃবৃন্দ।
২৭ মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব করেন ব্যারিস্টার আর নাথানের নেতৃত্বে ডি আর কুলচার, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নওয়াব সিরাজুল ইসলাম, আনন্দচন্দ্র রায়, জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ ললিত মোহন চট্টোপাধ্যায়, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ডব্লিউ এ টি আচির্বল্ড, ঢাকা মাদ্রাসার তত্ত্বাবধায়ক শামসুল উলামা আবু নসর মুহম্মদ ওয়াহেদ, মোহাম্মদ আলী, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ এইচ আর জেমস, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সি ডব্লিউ পিক এবং সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ সতীশচন্দ্র আচার্য। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিটির রিপোর্ট এবং সে বছরই ডিসেম্বর মাসে সেটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা পাশ করে ‘দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০’।
ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। সে সময়ের ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমন্ডিত রমনা এলাকায় প্রায় ৬শ একর জমির উপর পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশের পরিত্যক্ত ভবনাদি এবং ঢাকা কলেজের ভবনসমূহের সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড় উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন। যে সব প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষকতার সাথে জড়িত ছিলেন তারা হলেন, মহামহোপাধ্যায় পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফ সি টার্নার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জি এইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিউ এ জেনকিন্স, রমেশচন্দ্র মজুমদার, স্যার এ এফ রাহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ও ভারত বিভাজনের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান নামক পৃথক দু’টি জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটে। ফলে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খা উজ্জীবিত হয়। নতুন উদ্যমে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকান্ড শুরু করে। তৎকালীন পূর্ববাংলার ৫৫টি কলেজ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। ১৯৪৭-৭১ সময়ের মধ্যে ৫টি নতুন অনুষদ, ১৬টি নতুন বিভাগ ও ৪টি ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। যা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সোনালী অধ্যায়ের অংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রে নয় বরং জাতির বিভিন্ন ক্রান্তিকালেও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা।
অনেক চড়ায়-উৎরাই ও উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এটি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল। কিন্তু সে অতীত গৌরব এখন শুধুই ইতিহাস। অতীতে এই বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র্যাংকিং-এ উল্লেখযোগ্য অবস্থানে থাকলেও সে অবস্থা এখন আর অবশিষ্ট নেই। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই আমাদের জাতীয় গৌরব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অবনতি হতে শুরু করে। বর্তমানে তা একেকারে প্রান্তিক পর্যায়ে নেমে এসেছে। বিষয়টিকে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে ব্যাংখ্যা করছেন।
বিশ্ববিদ্যায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ-পঠনের মান, গবেষণা, আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানক্রম নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমাদের তেমন একটা সাফল্য নেই। গবেষণায় কম বরাদ্দ ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশনা সংখ্যা কম, শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা কম থাকা ও ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ না করার কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে থাকছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যা এখন রীতিমত উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল বাজেটের মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ গবেষণার ব্যয় করা হচ্ছে। এর ফলে কাঙ্খিত মানের ভালো গবেষণা হচ্ছে না। শিক্ষকদের মধ্যেও গবেষণায় আগ্রহ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশনাও কমছে। আর যেসব কাজ হচ্ছে সেগুলোও নিয়মিত ওয়েবসাইটে হালনাগাদ করা হয় না। এর ফলে র্যাংকিং সংস্থাগুলো অনকে সময় তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য পায় না। তাই বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে ভালো অবস্থান অর্জনে গবেষণা ও প্রকাশনা বাড়ানোর বিকল্প নেই। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের অবনতির জন্য এসবের বাইরে আরও কিছু কারণ রয়েছে।
উল্লেখিত কারণগুলো ছাড়াও আমাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানের অবনোমনে কম দায়ি নয়। ঢাবির শিক্ষার মান যে ক্রমেই নিম্নমুখী হচ্ছে তা সাম্প্রতিক এক গবেষণার ফলাফল থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ের জন্য বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘কুয়াকুয়ারেলি সাইমন্ডস’ (কিউএস)। শিক্ষা-গবেষণার মান ও পরিবেশ বিবেচনায় প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক র্যাংকিং প্রকাশ করে আসছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থাটি। কিউএস র্যাংকিংয়ের গত কয়েক বছরের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত আট বছরে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ২শ ধাপ অবনমন ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ‘টপ ইউনিভার্সিটিস ডটকম’ সূত্রে জানা যায়, কিউএসের ২০১২ সালের জরিপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক অবস্থান ছিল ৬০১তম। ২০২০ সালে এসে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৮০১তম। অর্থাৎ আট বছরের ব্যবধানে কিউএস র্যাংকিংয়ে ২০০ ধাপ পেছাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যা আমাদের দেশের শিক্ষার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
২০১২ সালের পর ২০১৩ সালে কোনো জরিপ প্রকাশ করেনি কিউএস। ২০১৪ সালে হঠাৎ করে ১০০ ধাপ অবনমন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান হয় ৭০১তম। এরপর ২০১৭ সাল পর্যন্ত র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান অপরিবর্তিত ছিল। ২০১৮ সালে গিয়ে কিছুটা অবনমন হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান দাঁড়ায় ৭০১-৭৫০ তম। এরপর ২০১৯ সালে এসে বড় অবনমন হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান দাঁড়ায় ৮০১-১০০০তম। ২০২০ সালেও বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে একই অবস্থানে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় অনেক আশা-আকাঙ্খা ও আন্দোলনের ফসল হলেও আমাদের জাতীয় ব্যর্থতার কারণেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড অতীত গৌরব হারিয়েছে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয় বরং আমাদের দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই এক অশুভ শক্তির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। আর এজন্য আমাদের নেতিবাচক রাজনীতিও কম দায়ী নয়। আদর্শহীন শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো স্বকীয়তা, অতীত ঐতিহ্য ও গৌরব হারিয়ে বসেছে। ক্ষয়িষ্ণু ও গন্তব্যহীন শিক্ষানীতির কারণেই শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি নিয়েই ব্যস্ত থাকছে। অবক্ষয় ও মূল্যবোধহীনতার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিক্ষক সমাজেরও ওপরও।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দলবাজ ও সুযোগ সন্ধানী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেও নামতে হয়েছে। একই সাথে একশ্রেণির শিক্ষার্থীদের টেন্ডারবাজি, কমিশনবাণিজ্য, প্রশাসনে আধিপত্য বিস্তার, আবাসিক হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনসহ নানা ধরনের কলঙ্কিত ঘটনার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
শিক্ষার্থীদের একটি বৃহৎ অংশ এখন মেধা ও মননের চর্চার পরিবর্তে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, দুর্নীতি, চাঁদাবাজী, সিট বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্যসহ নানাবিধ অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ছে। অথচ বিশ্ববিদ্যায়গুলো হওয়ার কথা ছিল মুক্তচিন্তার প্রাণ কেন্দ্র। মূলত আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে অস্থিরতার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে কিভাবে একশ্রেণির শিক্ষার্থীর হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হলগুলোর প্রশাসন। ফলে দেশে শিক্ষার মান ক্রম অবনতিশীলও বলতে হবে।
অনেক আশা-আকাক্সক্ষা ও আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু দেশের আদর্শহীন ও ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতির কারণে এটি স্বকীয় হারাতে বসেছে। গত ৮ বছর বিশ্ব র্যাংকিং-এ ২শ ধাপ অবনতি সে দিকেই অঙ্গুলী নির্দেশ করে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে কক্ষপথে ফিরিয়ে আনতে জাতীয় ঐক্যের কোন বিকল্প নেই। অন্যথায় জাতি হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষত্ব হলো বাংলাদেশ স্বাধীন করতে এর বিশেষ অবদান ছিল। যেখানে দেশের সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে বিশেষ অবদান রেখেছিল।