যৌনকর্মী থেকে ‘আশিকি ২’-এর লেখক

সিনেমাকেও হার মানায় তাঁর গল্প

নয়াবার্তা ডেস্ক : ‘আমরা ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম এক আত্মীয়ের সূত্র ধরে। সবাই পুরুষ, বেশির ভাগই নেশাগ্রস্ত। আমি ওড়নাটা কোমরে বেঁধে প্রাণভরে নাচলাম। লোকজন তালি দিল, টাকা ছুড়ল। তখনই বুঝে গিয়েছিলেন, তালি মানেই টাকা। অল্প বয়সেই সেই অঙ্ক কষে ফেলেছিলাম।’ শান্তভাবে কথাগুলো বলে এক দম দেন শাগুফতা রফিক। যে জীবন তিনি পেরিয়ে এসেছেন, এখন সেটা তাঁর নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকে। চরম দারিদ্র্যের জন্য কী না করেছেন জীবনে। বাধ্য হয়ে বেছে নিয়েছিলেন যৌনকর্মীর পেশা। সেই শাগুফতা এখন হিন্দি সিনেমার ঝলমলে দুনিয়ার বাসিন্দা। একাধিক হিট সিনেমার চিত্রনাট্যকার। তাঁর এ উত্থান নিজের লেখা সিনেমার চিত্রনাট্যের চেয়েও কম নয়।

দুঃস্বপ্নের শৈশব
শাগুফতা রফিকের জন্ম মুম্বাইয়ে। তাঁকে দত্তক নিয়েছিলেন অভিনেত্রী আনোয়ারি বেগম, যিনি ষাটের দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সাঈদা খানের মা। তবে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, অর্থাৎ দত্তক বাবার মৃত্যুর পর শাগুফতার জীবনে নেমে আসে দারিদ্র্যের কঠিন ছায়া।

শাগুফতা রফিক প্রথমবার পারফর্ম করেছিলেন মাত্র ১১ বছর বয়সে, মুম্বাই শহরের ব্যক্তিগত একটি পার্টিতে। সেই শুরু। এরপর জীবন তাঁর বারবার পরীক্ষা নিয়েছে। দিয়েছে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন এমন এক পরিবারে, যেখানে ছিল হিন্দি সিনেমার চাকচিক্য। আবার অন্ধকার পাশটাও ছিল ভয়ানক। বড় বোনই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। কিন্তু জীবনে কখনো সাফল্য পাননি। এক রাতে মদ্যপ স্বামীর গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। পরে স্বামীও আত্মহত্যা করেন।
শাগুফতার মা ছিলেন কলকাতার এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী, যদিও স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পাননি কখনোই। ব্যবসায়ীর মৃত্যুর পর তাঁর এই ‘দ্বিতীয় পরিবার’ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে।

নাচতেন, কারণ চুরি করতে চাননি
শাগুফতা নিজে দত্তক সন্তান। দারিদ্র্যের মুখে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, মাকে দেখবেন তিনি। ‘নাচতাম, কারণ চুরি করতে চাইনি। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, যেকোনোভাবে অর্থ উপার্জন করব,’ আল–জাজিরাকে বলেন তিনি।
শাস্ত্রীয় নৃত্যে প্রশিক্ষণ ছিল শাগুফতার। মা চেয়েছিলেন মেয়ে অভিনেত্রী হোক। পার্টিতে নাচ করে রাতপ্রতি ৭০০ রুপি রোজগার করতেন, যেখানে মাসে ৫০০ টাকায় চলত তাঁদের সংসার। কিন্তু একদিন পার্টিতে এক ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে অশালীন আচরণ করলে মা তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে আনেন।


সম্পর্ক, অসম্মান, পতন—তারপর ঘুরে দাঁড়ানো

১৭ বছর বয়সে এক ধনী ব্যক্তির উপপত্নী হন শাগুফতা। ‘সেই সময়টা ছিল সবচেয়ে অপমানজনক। সামান্য কিছু টাকার জন্য কেউ আমার স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চেয়েছিল,’ বলেন তিনি।

এরপর একসময় যৌনকর্মী হিসেবেও কাজ করতেন। আবার সেখান থেকে নিজেকে বের করে আনেন বার ড্যান্সে ফিরে গিয়ে। কখনো মুম্বাই, কখনো দুবাই—চাকরি নয়, টিকে থাকার যুদ্ধ চলতেই থাকে।

আল–জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শাগুফতা বলেন, ‘এই চক্র ছিল নিষ্ঠুর, একটা অবস্থা থেকে পালাতে চাইলে আরেকটা খারাপ অবস্থায় জড়িয়ে পড়তাম। যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করেছি বাধ্য হয়ে। সেখান থেকে পালাতে গিয়ে হলাম বার ড্যান্সার, তারপর মুম্বাই ছেড়ে দুবাই…এভাবেই চলছিল জীবন।’

এই সময়েই শাগুফতা লেখার প্রতি ভালোবাসা খুঁজে পান। সিনেমার গল্প লেখার ইচ্ছায় ঘুরতে থাকেন প্রযোজনা সংস্থার অফিসে, কিন্তু অভিজ্ঞতা না থাকায় কেউ তাঁকে কাজ দেননি। তবু হাল ছাড়েননি, বারে বসে, সস্তা হোস্টেলে, যেখানে যখন সময় পেতেন, লিখে যেতেন।


গল্পে থাকে বাস্তব, থাকে টান
চিত্রনাট্যকার অমিত মাসুরকর বলেন, ‘বেশির ভাগ লেখক মাথা দিয়ে লেখেন, কিন্তু শাগুফতা লেখেন হৃদয় থেকে। তাই তাঁর গল্পগুলো এত জীবন্ত, এত মানুষকেন্দ্রিক।’

সেই কঠিন সময়েই শাগুফতার মনে জন্ম নেয় গল্প বলার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা। লেখালেখিতে কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও নিজের জীবনের যন্ত্রণা আর অভিজ্ঞতা থেকেই গড়ে তুলতে থাকেন চরিত্র ও গল্প। কিন্তু বলিউড তখনো তাঁকে গ্রহণ করতে চায়নি। ‘আমি অনেক প্রোডাকশন হাউসে গিয়ে কাজ চেয়েছি, কিন্তু সবাই বলত, আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই,’ বলেন তিনি।

ভাগ্য ফেরাল মহেশ ভাটের ‘বিশেষ ফিল্মস’
২০০০ সালে বহু চেষ্টা করে একবার দেখা পান মহেশ ভাটের। সেই সাক্ষাৎ একদিন শাগুফতাকে এনে দেয় প্রথম সুযোগ—একটি ছবিতে কিছু দৃশ্য লেখার। মহেশ ভাটের প্রযোজনা সংস্থা বিশেষ ফিল্মসে প্রথম চিত্রনাট্য লেখেন ২০০৬ সালের ‘ওহ লমহে’ ছবির জন্য। এরপর ‘আওয়ারাপন’, ‘রাজ ৩’, ‘মার্ডার ২’, ‘জান্নাত ২’, ‘আশিকি ২’, ‘জিসম ২’—একটি পর একটি হিট ছবির চিত্রনাট্য লেখেন তিনি। বিশেষ করে ইমরান হাশমি ও আদিত্য রায় কাপুর অভিনীত ছবির সাফল্যের পেছনে বড় অবদান তাঁর কলমের।

পরিচালনার নতুন অধ্যায়
২০১৯ সালে চিত্রনাট্যকারের পরিচয়ের বাইরে গিয়ে পরিচালক হিসেবে নতুন এক অধ্যায় শুরু করেন শাগুফতা। পরিচালনা করেন বাংলা অ্যাকশন থ্রিলার ‘মন জানে না’। এ ছাড়া ‘দুশমন: আ স্টোরি অব দ্য এনেমি উইদিন’-এর মতো ছবি দিয়ে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেন অন্য ভূমিকায়।
২০টিরও বেশি ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন শাগুফতা। কাজ করেছেন বলিউডের সেরা পরিচালকদের সঙ্গে। মহেশ ভাট বলেন, ‘শাগুফতা অসাধারণ এক প্রতিভা। ওর গল্পগুলো জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। জীবনের তিক্ততা, অভিজ্ঞতা থেকেই সে গল্প খুঁজে পায়।’

এখনো লড়াই শেষ হয়নি
সাফল্যের পরও একধরনের সামাজিক বিরূপতা যেন শাগুফতাকে আজও ছাড়ে না। ‘অনেকে শুধু আমাকে দেখতে চান—ভেবে নেন, আমি একজন বার ড্যান্সার তাই হয়তো দেখতে আলাদা হব,’ আক্ষেপ নিয়ে বলেন তিনি।

১৯৯৯ সালে ক্যানসারে মা মারা যাওয়ার পর এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পান শাগুফতা। ‘আমার মাও আমার বয়সে বিধবা হয়েছিলেন, তাঁর জীবন সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ আমার কাছে জীবন মানে নতুন করে শুরু,’ বলেন তিনি। অনেকেই অতীত নিয়ে কথা বলেন না। কিন্তু শাগুফতা সব অকপট বলেন।

তাঁর অতীত নিয়ে মুখ খোলার সিদ্ধান্ত অনেকেই নিন্দা করে। কিন্তু শাগুফতার জবাব সোজাসাপটা, ‘আমি কাউকে আমার নৈতিকতা নিয়ে চর্চার সুযোগ দিতে চাই না। এটা আমার জীবন। আমি-ই বলব আমার গল্প।’

একসময় শাগুফতা বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয়েছিলেন সমাজের চোখে ‘অপমানজনক’পেশা বেছে নিতে, তিনিই আজ বলিউডের আলোচিত চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক। তাঁর জীবন কেবল একটি ব্যক্তিবিশেষের সংগ্রামের গল্প নয়; বরং নারীদের জন্য প্রেরণার নাম। শাগুফতা মনে করেন, একটি সিদ্ধান্তেই তাঁর জীবন বদলে গিয়েছিল। আর সেটা হলো, তিনি ঠিক করেছিলেন নিজের জীবনের গল্প নিজেই লিখবেন, অন্য কাউকে লিখতে দেবেন না। তিনি এতে সফল হয়েছেন বলাই বাহুল্য।
তথ্যসূত্র: আল–জাজিরা, ডিএনএ, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

Share