তালেবানের ক্ষমতা দখল : সহিংসতা ও মিথ্যা আশার পর এখন শুধুই হতাশা

ভয় আর আতঙ্ক ছড়িয়ে দেশ শাসন করে যাওয়া তালেবান যখন আবার আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রক হওয়ার পথে, সে সময় কী ভাবছিলেন কাবুলের বাসিন্দারা? তালেবানকে হটিয়ে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখানো যুক্তরাষ্ট্রের হঠাৎ পিঠটান নিয়ে সাধারণ আফগানদের ভাবনাই-বা কী—এসব নানা বিষয় নিবন্ধে তুলে এনেছেন নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিনিধি মুজিব মাশাল। কাবুলে বেড়ে ওঠা মুজিব মাশাল ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের খবর সংগ্রহ করেছেন। বর্তমানে তিনি নিউইয়র্ক টাইমস-এর নয়াদিল্লি ব্যুরোতে কাজ করছেন।

তালেবান কাবুলে ঢোকার কয়েক ঘণ্টা আগে যখন আফগানিস্তানকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার দুই দশকের প্রচেষ্টা অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কে রূপ নিয়েছিল, সেই সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি একটি বাসে উঠি। এই যাত্রা সংবাদ সংগ্রহের জন্য ছিল না। এটা ছিল ব্যক্তিগত।

১৫ আগস্ট সকালে আমি যখন ঘুম থেকে উঠি, তখন এমন অনুভূতি হচ্ছিল যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আমরা যে কাবুলকে দেখেছি, তার সেই জানালা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তালেবানের হাতে এত দ্রুতগতিতে একের পর এক শহরের পতন হচ্ছিল যে এই যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত আমার সহকর্মীরা তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। মানচিত্র বদলের সঙ্গে রাজধানীর দুটি সম্ভাবনা সামনে চলে আসে—ক্ষমতাসীনদের রক্ষার প্রচেষ্টায় কাবুল আবার ধ্বংসাবশেষে রূপ নেবে অথবা চরমপন্থীদের হাতে কাবুলের পতন হবে, যে চরমপন্থীরা দমন-পীড়নের মাধ্যমে দেশ শাসন এবং মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল।

২০০১ সালে তালেবান যখন ক্ষমতাচ্যুত হয়, তখন আমার ছেলেবেলা। রাজধানীতে যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে নতুন প্রাণ আনার চেষ্টার মধ্যে আমার বেড়ে ওঠা। তখনো সব সময় গৃহযুদ্ধের ভয় কাজ করত। এরপর বছরের পর বছর বিশ্ব মনে করত, আমাদের অনেকের সামনে নতুন সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। যদিও আফগানিস্তানে ক্রমশ যুদ্ধে রক্তপাত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে উদ্বেগ ছিল।

এখন কাবুলে আরেকবার ক্ষমতার পালাবদলের প্রাক্কালে আমি আবার আমার শহরে ফিরে এসেছি। পরিবার ও সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা করার জন্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর দিল্লি ব্যুরোর দায়িত্ব থেকে সাময়িক বিরতি নিয়ে আমার এই ফেরা। আমি জানতাম, এখানকার সবাইও জানতেন, আশাবাদের সময় শেষ হয়ে আসছে।

অনাগত দিনগুলোতে বিশ্ব এই ছোট জাতির সর্বশেষ বিপর্যয়ের দিকেই দৃষ্টি রাখবে। আর তা হতে চলেছে কয়েক বছরের নিত্যকার ভয়াবহ রক্তপাতের ঘটনা অবলোকনের পর। অন্য দেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ফ্লাইট ধরার আশায় কাবুল বিমানবন্দরের দিকে নামা মানুষের ঢল থেকে শুরু করে যেকোনো জায়গায় ক্যামেরা জুম করা হবে। উদ্ধার পাওয়ার আশায় বিমানবন্দরের বাইরে কাগজপত্র হাতে অপেক্ষারত মানুষের রক্ত মিশেছে নর্দমায়। সন্ত্রাসী ওই হামলা ১৭০টি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।

যাঁরা উড়োজাহাজের একটি আসন পেয়েছিলেন, তাঁরা দূরবর্তী কোনো দেশে নেমে হঠাৎ হয়ে উঠলেন নির্বাসিত। যাঁরা থেকে গেলেন, তাঁরা আমাদের নিজেদের ভূমিতে হয়ে উঠলেন নির্বাসিত।

কিন্তু এসব কিছুর আগে আমি শেষবারের মতো আমাদের শহরটা দেখতে চেয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির কাছের প্রধান মোড়টিতে ফুল দিয়ে সাজানো একটি বিয়ের গাড়ি দেখতে পেলাম। যুদ্ধ বা শান্তি যা-ই হোক, বিয়ে তার মতো করে হয়।

একপর্যায়ে শহরতলির দিকে যাত্রা করা একটি বাসের পেছন দিকে জানালার পাশের একটি সিটে বসলাম। আমার সামনের যাত্রীদের কারও কারও কাছে নানা কাগজপত্র। আবার কেউ কেউ ফোন ঘাঁটছিলেন। অষ্টম গ্রেডের এক শিক্ষার্থী তাঁর ভূগোল বইয়ে চোখ বোলাচ্ছিলেন। তাঁর গ্রীষ্মকালীন পরীক্ষার শেষ বিষয় ছিল এটি। মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি পুরোনো একটি নকিয়া ফোন হাতে নিয়ে বাসযাত্রীদের দ্বিতীয় সারি থেকে শেষ পর্যন্ত ছোটাছুটি করছিলেন আর একের পর এক ফোন করছিলেন। বিভিন্ন প্রদেশে তীব্র লড়াইয়ের মধ্যে পালিয়ে আসা শরণার্থীর ঢল চলছে কাবুলে। এসব মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে বন্ধু ও আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি।

বাসের সবাইকে চিন্তিত মনে হচ্ছিল। সেখানে উত্তাপ ছড়াতে বেশিক্ষণ লাগল না। শুরুটা হলো পেছনের সারিতে বসা এক তরুণের মাধ্যমে। মাস্ক নামিয়ে মুখে এক চিমটি তামাক ঢোকান তিনি। ফোনে কথা বলতে থাকা ওই ব্যক্তি তাঁর দিকে তাকালেন এবং বলে উঠলেন, ‘এটা কি তোমার স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো?’ তরুণটি তাঁর দিকে তাকালেও কিছু বললেন না। কিন্তু তাঁর সামনে বসা জাবিউল্লাহ নামের একজন আইনজীবী মধ্যবয়সী ওই ব্যক্তির উদ্দেশে বললেন, ‘তালেবান এখনো কাবুলে আসতে পারেনি। আর আপনি এখনই লোকজনের আচরণ নিয়ে পুলিশগিরি করছেন?’ এরপর একে একে দুর্নীতি, গণতন্ত্র, ব্যর্থতা, পরিবর্তনসহ যাবতীয় বিষয় আলোচনায় উঠে এল। বয়স্ক ব্যক্তি বললেন, তালেবান অন্তত অনিয়ম-দুর্নীতি ও সমাজ থেকে ‘অশ্লীলতা’ দূর এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারবে। তাঁর এ কথায় তরুণ আইনজীবী মেজাজ হারালেন। তিনি বললেন, ‘আপনার কি মনে হয় গত ২০ বছরে শুধু একটি জিনিস—অশ্লীলতাই এসেছে? আমিও গত ২০ বছরে বেড়ে উঠেছি। আপনার কি মনে হয় আমি অশ্লীল?’ বয়স্ক লোকটি তাঁর বক্তব্য সংশোধন করতে চাইলেন। কিন্তু ওই আইনজীবী থামছিলেন না। তিনি বলে চলেন, ‘আপনি যদি মনে করেন তালেবান সত্যিকার ইসলামের চর্চা করে, তাহলে আপনি ভুল করছেন। আমি আপনার সঙ্গে সারা রাত প্রমাণসহ আলোচনা করতে পারি যে তারা যেটা চর্চা করছে, তা তালেবানবাদ, সত্যিকার ইসলাম নয়।’

যানজটে পড়লে আইনজীবী ও আমি বাস থেকে নেমে গেলাম। ওই আইনজীবী বিচারকের চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য তাঁর কাগজপত্র প্রস্তুত করছিলেন। ক্যালিগ্রাফিও রপ্ত করেছিলেন তিনি। তাঁর ফোনে থাকা এই কাজের কয়েকটি আমাকে দেখালেন তিনি। বিদায় নেওয়ার সময় বললেন, ‘২০ বছরের চেষ্টার ফসল, সবকিছুই বৃথা।’

তালেবানের কাবুলে আসাটা তখনো শুধু একটি সম্ভাবনাই ছিল। কিন্তু সবকিছু দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল। যখন আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখী সরু রাস্তা ধরলাম, তখন চারপাশে আতঙ্কের ছায়া। বিপণিবিতান, বিভিন্ন সরকারি অফিস এবং অনেক অভিজাতের বসবাসের এই এলাকার রাস্তায় তড়িঘড়ি করে চলা গাড়িগুলোও আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল। সশস্ত্র পাহারায় থাকা ভিআইপিদের গাড়িগুলো যাওয়া-আসা করছিল।

তালেবান শহরে ঢুকতে শুরু করার আগে আমি যেসব জায়গায় গিয়েছিলাম, তার একটি ছিল স্লাইস ক্যাফে অ্যান্ড বেকারি। স্বাভাবিক সময়ে এখানে কফি খেতে আসা তরুণদের ভিড় লেগে থাকে। রাজনৈতিক বিতর্ক থেকে প্রেমিক-প্রেমিকার সময় কাটানো, মিথ্যা ভালোবাসায় ভোলানোর মতো নানা ঘটনা এখানে এলেই দেখা যেত।

এদিন এই ক্যাফে ছিল প্রায় ফাঁকা। এক টেবিলে দুই নারী ছিলেন। তাঁরা দুজনই মেডিকেলের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। আরেক টেবিলে ছিলেন একজন নারী, যিনি ইতিমধ্যে ডাক্তারি শুরু করেছেন। তাঁর সঙ্গে দুই শিশুসন্তান ছিল। ওই চিকিৎসক বলেন, তাঁর স্বামী বিদেশে থাকেন। এখন তাঁর শুধু চিন্তা, যদি শহরে তালেবান চলে আসে এবং তাদের আগের সেই শাসন চালু করে, তাহলে তিনি কোনো পুরুষের সাহায্য ছাড়া কীভাবে প্রতিদিনের বাজার এবং শিশুদের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সংগ্রহ করবেন।

মেডিকেল শিক্ষার্থীদের একজন বলেন, ‘আমি কখনো খবরের মধ্যে ছিলাম না। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরে ফোন আমার হাতে এবং আমি সব সময় স্ক্রল করছি আর কোন প্রদেশের পতন ঘটল, তা দেখছি। মাথার ওপর দিয়ে যাওয়া হেলিকপ্টারগুলো ভয় আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় আজ পরীক্ষা বাতিল করেছে। কারণ, গত দু-তিন বিষয়ের পরীক্ষায় তাঁদের সবাই খুব খারাপ করেছেন। কেউই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।

এরপরের দিনগুলোতে কাবুল নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। অনেক কিছুই তালেবানের নব্বইয়ের দশকের শাসনকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। যদিও তাদের ঘোষণায় নরম সুর এসেছে। অন্যদিকে ছোটখাটো অপরাধ কমে গেছে। রাস্তায় বেরোলে শারীরিকভাবে আক্রান্ত হওয়ার দিক দিয়ে তুলনামূলক নিরাপদ বোধ হচ্ছে। তালেবানও বিষয়টি জোরেশোরে বলছে যে বিমানবন্দরের ঘটনা ছাড়া এত দিন যুদ্ধে দৈনিক ৫০ থেকে ১০০ জন নিহত হতো, তা এখন শূন্যের কাছাকাছি চলে এসেছে।

এদিকে এমন ঘটনাও ঘটছে, যেগুলো পুরো বিশ্বকে নাড়া দিচ্ছে—কাবুল থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার সময় মার্কিন উড়োজাহাজ আঁকড়ে ধরা তরুণ আফগানের পড়ে গিয়ে করুণ মৃত্যু; পশ্চিমাদের এই উদ্ধার তৎপরতার শেষ দিনগুলোতে পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় হাজার হাজার আফগান পরিবারের বিমানবন্দরের বাইরে এসে জড়ো হওয়া; আরেকটি আত্মঘাতী হামলার বীভৎসতা এবং আরও একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির শঙ্কা, এমনকি তালেবানের জন্যও।

দেশত্যাগের জন্য যাঁরা মরিয়া চেষ্টা করছেন, তাঁদের অনেকেই তালেবানের হাতে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে আছেন। কিন্তু তার চেয়ে বড় একটা কিছু রয়েছে তা হলো, একজন মানুষ তাঁর দেশ ত্যাগ করছেন।

৪০ বছরের সহিংসতা এবং এত এত মিথ্যা আশাবাদ ও বিভ্রান্তিকর বুলির পর আফগানদের মনে যা জায়গা পাচ্ছে তা হলো হতাশা—ভয়ের হচ্ছে, এবার আলাদা কিছুই হবে না, আরও খারাপ কিছু হওয়া ছাড়া।

Share