তিনি কখনো আমাকে ফিরিয়ে দেননি

কামরুন নেসা হাসান : আলাউদ্দীন আলী ভাইয়ের সঙ্গে অনেক স্মৃতি। আজ সেসব খুব মনে পড়ছে। দুই দিন আগে যখন শুনলাম তিনি আইসিইউতে, তখন থেকেই মনটা ছটফট করছিল। অনেক দিন ধরেই কষ্ট পাচ্ছিলেন। তবু তাঁর চলে যাওয়া মেনে নিতে পারি না।

আশির দশকের মাঝামাঝি এক স্বাধীনতা দিবসের কথা। সালটা আজ মনে পড়ছে না। তখন আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রযোজক। একটি সংগীতানুষ্ঠানে আলী ভাইকে সুরকার হিসেবে কাজ করতে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন, অফিসে বসে কথা বলতে চান। স্বাধীনতা দিবসে কীভাবে দর্শকদের একটা ভালো অনুষ্ঠান উপহার দেওয়া যায়, এ নিয়ে আলোচনা করতে পরদিন তিনি অফিসে এলেন।

প্রস্তাবটি আমিই দিলাম। কবি শামসুর রাহমান ১০টি দেশের গান লিখুক, আলাউদ্দীন আলীর সুরে সেগুলো গাইবেন সাবিনা ইয়াসমীন। পরিকল্পনা শুনে সুরকার ও শিল্পী দুজনেই মহা খুশি। কিন্তু শামসুর রাহমান কি গান লিখবেন? দ্বিধায় ছিলাম। তক্ষুনি আমি কবিকে ফোন করলাম। কথা বলতে বলতে তাঁকে অনুরোধ করে বললাম, রাহমান ভাই, আমাকে ১০টি দেশের গান লিখে দিতে হবে। শুনে মনে হলো তিনি চমকে উঠলেন। তিনি বললেন, ‘গান লেখা অত সহজ না।’ তাঁকে রাজি করতে বললাম, রাহমান ভাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখে যতটা জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন গানের জন্য। আপনাকেও লিখতে হবে, এ আমার অনুরোধ। গানগুলো সুর করবেন আলাউদ্দীন আলী আর গাইবেন শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীন। আপনি আলাউদ্দীন আলী ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন।’ আলাউদ্দীন আলী ভাইও ফোনে তাঁকে অনুরোধ করলেন। কবি রাজি হলেন। জানালেন, গানগুলো তিনি পরের সপ্তাহে দেবেন। শুনে আমরা আনন্দে যেন আকাশে উড়াল দিই। আমাদের মিশন সফল।

যথাসময়ে গানগুলো পেয়ে কবিকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। আটটা গান সাবিনা ইয়াসমীন আর একটি করে গান রফিকুল আলম ও এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে রেকর্ড করা হলো। সে সময় টেলিভিশনে অডিও ধারণের নির্দিষ্ট কোনো স্টুডিও ছিল না। ভালো মানের রেকর্ডিংয়ের জন্য সুরকার এবং শিল্পীরা নিজেদের টাকায় ভালো স্টুডিও থেকে রেকর্ড করে আনতেন। আমাদের গানগুলোও যথারীতি বাইরে থেকে রেকর্ড করিয়ে আনা হলো। সাবিনা গাইলেন, ‘এই যে আমার খুকির ঠোঁটে ফুটছে হাসি’, ‘স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথায় আর কতকাল তুমি করবে শোক’, ‘স্বপ্নে আমার যে দেশ ওঠে জেগে’ গানগুলো। এন্ড্রু কিশোর গেয়েছিলেন ‘নয় কোটি জনতা জাগ্রত আজ’ গানটি। কথা, সুর এবং গায়কি মিলিয়ে গানগুলো হয়ে উঠল এক অনবদ্য সৃষ্টি।

এরপর শুটিংয়ের পালা। ১০টি গান ১০টি লোকেশনে শুটিং করা হলো। ‘এই যে আমার খুকির ঠোঁটে ফুটছে হাসি’ গানটি শুটিং করা হলো বোটানিক্যাল গার্ডেনে। একটি স্কুল থেকে অনেকগুলো বাচ্চাকে নিয়ে আসা হলো। সাবিনাসহ সেই শিশুদের নিয়ে গানটি চমৎকারভাবে ধারণ করা হয়। ‘স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথায়’ করা হলো সাভার স্মৃতিসৌধে, ‘স্বপ্নে আমার যে দেশ ওঠে জেগে’ গানটি আশুলিয়া আনসার ক্যাম্পে। নারী আনসার সদস্যরা সেই গানে দারুণ পারফর্ম করেছিল। ঘটনাগুলো মনে পড়ছে। কারণ, উপমহাদেশের নামকরা সুরকার, যিনি এ গানগুলোর সুর করেছিলেন, তিনি আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। যে কদিন যত লোকেশনে শুটিং করেছিলাম, আলাউদ্দীন আলী ভাই সারাক্ষণ সঙ্গে থেকেছেন। চিত্রগ্রাহক ছিলেন আনোয়ার হোসেন বুলু। সবার আন্তরিক সহযোগিতায় একটি মানসম্মত অনুষ্ঠান প্রযোজনা করতে পেরে সেদিন নিজেকে ধন্য মনে হয়েছিল। অনুষ্ঠানটি প্রচারের পরদিন বিটিভির তখনকার মহাব্যবস্থাপক প্রয়াত মোস্তফা কামাল সৈয়দ সাধুবাদ জানালেন। আমার চোখ আনন্দে ছলছল করে উঠল।

আলাউদ্দীন আলী ভাই বেশি ব্যস্ত থাকতেন চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার কাজে। তবু টেলিভিশনের বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানের জন্য যখনই তাঁকে অনুরোধ করতাম, তিনি কখনো আমাকে ফিরিয়ে দেননি। তিনি বলতেন, ‘আমি অনেক ব্যস্ত। কিন্তু আপনি বললে “না” করতে পারি না।’ এই ভালো লাগা, শ্রদ্ধাবোধ কি আর পাব! বড় অসময়ে চলে গেলেন তিনি।

আলাউদ্দীন আলীর প্রতিভার কথা বলে শেষ করা যাবে না। একসময় বেহালার সুরে মগ্ন থাকতেন তিনি। পরে গানের মাধ্যমে সেই সুরের আবেশ তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের অন্তরে। তাঁর গানগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে আগামী প্রজন্ম তাঁর সম্পর্কে জানতে পারবে এবং গর্বিত বোধ করবে এই ভেবে যে একজন মহান সংগীতজ্ঞের গর্বিত উত্তরসূরি তাঁরা। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।

লেখক: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির পরামর্শক

Share