দুর্নীতির অপরাধ কখনো তামাদি হয় না

প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য : দুর্নীতি কোনো দেশের একক সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা। মানব সভ্যতার প্রাচীনতম এই অপরাধ আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলেছে। দুর্নীতি যেন কুৎসিত অভিশাপ হয়ে মানব সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়। গিরগিটির মতো দুর্নীতির রূপ ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়। চাণক্যের অর্থ শাস্ত্রে বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতির চমকপ্রদ উদাহরণ পাওয়া যায়। বিশ্ব গণমাধ্যমেও বিভিন্ন দুর্নীতির সংবাদ দেখা যায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে বা যারা এ জাতীয় অপরাধের সাথে জড়িত তাদের অনেকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, কেউ কেউ নিজেদেরকে অভিজাত বলে দাবিও করেন, আবার কেউ কেউ পেশাগত বা সামাজিকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ, তবে এরা সবাই অর্থ-বিত্তের মোহে মোহাচ্ছন্ন। এরা সবাই নির্লজ্জ, লোভী ও অবিবেচক।

বিশ্ব কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের “দুই বিঘা জমি” কবিতার এই চরণটি হতে পারে দুর্নীতির একটি চমৎকার উদাহরণ। চরণটি এমন -“ পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে- করিল ডিক্রি , সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে। এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি, ভূরি-রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।” বিশ্ব কবি এই চরণটির মাধ্যমে দুর্নীতির একটি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মহাক্ষমতাধর জমিদার বাবুর সর্বগ্রাসী লোভ জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যার আশ্রয়ে পরিপূর্ণ হয়েছিল। আধুনিক কালের দুর্নীতিও লোভ থেকেই উৎসরিত হয়। মিথ্যা, জাল-জালিয়াতিই দুর্নীতি সংঘটনের অন্যতম মাধ্যম।

সাধারণত লোভ থেকেই মানুষ দুর্নীতির পথে ধাবিত হয়। ভোগবাদিতার প্রতি মানুষের তীব্র আকর্ষণও দুর্নীতির অন্ধকার পঙ্কিল পথে মানুষকে পরিচালিত করে। দুর্নীতির পরিণতিও কিন্ত বেদনাদায়ক। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দুর্নীতি ফৌজদারি অপরাধ। এ অপরাধ কখনও তামাদি হয় না। অর্থাৎ অপরাধ সংঘটিত হলে আজ হোক বা কাল হোক তা আইনি তদন্তের সুযোগ রয়েছে।

দুর্নীতি এবং দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত বিষয়। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন দুর্নীতিপরায়ণদের শাস্তি হচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিকভাবেই অঙ্গীকারাবদ্ধ। তারপরও স্থান-কালপাত্র ভেদে দুর্নীতির সংজ্ঞা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। সাধারণ মানুষ মনে করে নীতি বহির্ভূত যে কোনো কাজই দুর্নীতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টার ন্যাশনাল এর মতে “অর্পিত ক্ষমতা অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত লাভ অর্জনই দুর্নীতি । বিশ্বব্যাংকের মতে, “পাবলিক অফিসের অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত লাভই দুর্নীতি।”

উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে, “দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো আদর্শের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক অসাধুতা বা বিচ্যুতি দুর্নীতি নির্দেশ করে।” তাদের মতে দুর্নীতি শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন এরিস্টটাল।

বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ অনুসারে দুদক আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধকে দুর্নীতিমূলক কার্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মূলত দুদক আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধসমূহ বলতে ১৮৬০ সালের পেনাল কোড বা দণ্ডবিধির কতিপয় ধারা ; ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধসমূহ এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধসমূহ ইত্যাদি। সাধারণ মানুষের পক্ষে দুদক আইনের তফসিল সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া কঠিন বলেই মনে করা হয়। বাস্তবতা হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ দুদক আইনের তফসিল সম্পর্কে কাঙ্খিত মাত্রায় সচেতন নন। ঠিক এ কারণেই দুর্নীতি দমন কমিশনে হাজার হাজার অভিযোগ আসলেও সকল অভিযোগ অনুসন্ধান বা আমলে নেওয়ার আইনি সুযোগ নেই। যৌতুক, বাল্য বিবাহ, নারী নির্যাতন, বেসরকারি ভূমি সংক্রান্ত ব্যক্তিগত বিরোধ, ব্যক্তিগত ব্যবসার দেনা-পাওনা, সামাজিক বিচার ব্যবস্থার অনিয়ম, জোর করে বেসরকারি ব্যক্তির সম্পত্তি দখলসহ নানাবিধ এ জাতীয় অভিযোগ প্রায়শই কমিশনে এসে থাকে। বাস্তবতা হচ্ছে এসব অভিযোগ দুদক আইনের তফসিল বহির্ভূত অপরাধ।

দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা, ২০০৭ অনুযায়ী কমিশনে দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগ দায়ের ও যাচাই-বাছাই কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এ বিধি অনুসরণ করে কমিশনে অভিযোগ গ্রহণ ও যাচাই-বাছাইসংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্ব পালনের নিমিত্ত ‘অভিযোগ যাচাই-বাছাই সেল’ রয়েছে। এই সেল বিভিন্ন অংশীজন ও উৎস থেকে কমিশনে আসা অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করে থাকে। ২০১৭ সালে কমিশন অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে গ্রেডিং পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে। গ্রেডিং পদ্ধতি প্রবর্তন করায় অভিযোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে দুদকের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর প্রভাবিত হওয়ারও সুযোগ নেই। নির্ধারিত নম্বর না পেলে কোনো অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয় না। মূলত অভিযোগের বস্তুনিষ্ঠতা, ব্যাপকতা, আর্থিক সংশ্লেষের পরিমাণ, অভিযোগকারী ও অভিযোগ সংশ্লিষ্টের পরিচয়, সর্বোপরি বিদ্যমান আইন ও বিধি-বিধান পর্যালোচনা করেই অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয়।

এমন বাস্তবতায় দুদকে অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে বর্ণিত তফসিল অনুসারেই অভিযোগ দায়ের করা সমীচীন। তা না হলে অভিযোগকারীর কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে। কারণ তিনি হয়তো ভাবছেন অভিযোগ যেহেতু দায়ের করেছি, হয়তো তা অনুসন্ধান করবে দুদক। প্রকৃতপক্ষে দুদক আইনে তফসিল বহির্ভূত অপরাধের বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই বললেই চলে।

এ প্রেক্ষাপটে দুদক আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধসমূহের সম্পর্কে পাঠকদের সম্যক ধারণা দেওয়ার জন্য দুদক আইনের অধীন অপরাধগুলো হলো- সরকারি কর্তব্য পালনের সময় সরকারি কর্মচারী/ব্যাংকার/সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত যে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক উৎকোচ (ঘুষ)/উপঢৌকন গ্রহণ; সরকারি কর্মচারী/সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত যে কোনো ব্যক্তি বা অন্য যে কোনো ব্যক্তির অবৈধভাবে নিজ নামে/বে-নামে সম্পদ অর্জন; সরকারি অর্থ/সম্পত্তি আত্মসাৎ বা ক্ষতিসাধন; সরকারি কর্মচারী উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে ব্যবসা/বাণিজ্য পরিচালনা; সরকারি কর্মচারী কর্তৃক জ্ঞাতসারে কোনো অপরাধীকে শাস্তি থেকে রক্ষার প্রচেষ্টা; কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনকল্পে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক আইন অমান্যকরণ; মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর অধীন সংঘটিত অপরাধসমূহ এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী/ব্যাংকার কর্তৃক জাল-জালিয়াতি এবং প্রতারণা ইত্যাদি।

একথা সত্য দুদক প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দুর্নীতি দমনে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ অনুসন্ধান করে মামলা দায়ের, মামলা তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল, প্রসিকিউটিং সংস্থা হিসেবে আদালতে মামলা পরিচালনা করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতে আইনি দায়িত্ব পালন করছে। দুদকের মামলায় অসংখ্য মানুষের শাস্তি হয়েছে। দুদকের মামলায় সাজার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুদক শুধু মামলা-মোকদ্দমা তথা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বসে নেই। পাশাপাশি কমিশন দুর্নীতি প্রতিরোধে সচেতনতামূলক বহুমাত্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বহুমাত্রিক এসব কার্যক্রম দর্নীতিবিরোধী চেতনার বিকাশ ঘটাচ্ছে। বাহ্যিকভাবে অনুধাবন করা না গেলেও কমিশন নিজস্ব কর্মকৌশলের আলোকে ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট টার্গেট গ্রুপকে লক্ষ্য রেখে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি ঘটার আগেই প্রতিরোধমূলক আগাম অভিযানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা। মধ্যমেয়াদি কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে গণশুনানিসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির কার্যক্রম। মূলত এসবের মাধ্যমে সর্বস্তরের পরিণত মানুষকে দুর্নীতি বিরুদ্ধে সচেতন করা হচ্ছে।

তরুণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত সততা সংঘের সদস্যদের মাধ্যমে পরিচালিত দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম যেমন বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, রচনা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দেশের তরুণ প্রজন্মকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন ও সংবেদনশীল করা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট গ্রুপ হচ্ছে এই তরুণ প্রজন্ম। তরুণ প্রজন্মের মাঝে নৈতিকমূল্যবোধ জাগিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ করার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ তরুণরাই আগামী দিনের বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে। তাদের মননে সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম, কর্মস্পৃহা জাগিয়ে তোলা গেলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তা হবে টেকসই উদ্যোগ। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের টার্গেট গ্রুপও তরুণরাই। এই কৌশলের অংশ হিসেবেই দেশের ২৬ হাজার ২১৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাদের নৈতিকমূল্যবোধ বিকাশে বিতর্ক প্রতিযোগিতা পরিচালনা করছে দুদক। কমিশন এই কর্মপ্রক্রিয়ায় জিও-এনজিও সকলকে সম্পৃক্ত করেছে। স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসন, শিক্ষা বিভাগ, তথ্য বিভাগকে যেমন এসব কাজে সম্পৃক্ত করা হয়েছে তেমনি অক্সফামের মতো এনজিওকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। জিও-এনজিওর সমন্বয়ে কমিশনের এসব কার্যক্রমকে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশীদারিত্বের দৃষ্টান্ত বলা যেতে পারে।

দুর্নীতি, বৈষম্য, মাদক, সন্ত্রাসের মতো নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে তরুণরা যাতে সম্পৃক্ত না হয়, জীবনের পথপরিক্রমায় কোনটি সঠিক বা কোনটি ভুল তা নির্ণয় করার সক্ষমতা যাতে তারা অর্জন করতে পারে- সে লক্ষ্যেই দুদকের এ প্রয়াস। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সমন্বিত সামাজিক আন্দোলনই দুর্নীতিকে স্তব্ধ করতে পারে।

Share