নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : ‘ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’—একসময়ের জনপ্রিয় এই বাংলা গানের প্রথম লাইনটি কিন্তু ‘বেঙ্গল টাইগার’ চেনার মূল সূত্র। কারণ, একটি বাঘের গায়ের ডোরাকাটা দাগের সঙ্গে আরেকটির মেলে না। কলার রেডিও পরানোর পর ভারতীয় সুন্দরবন অংশ থেকে একটি বাঘ বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনে এসেছে। গায়ের ডোরাকাটা দাগ বলছে, বাঘটি বাংলাদেশেরই। কোনো কারণে সে ভারতীয় সুন্দরবনে চলে গিয়েছিল। দেশের বাঘ আবার দেশেই ফিরে এসেছে।
ভারতের বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তারা ভারতীয় সুন্দরবনের বশিরহাট এলাকায় বাঘটিকে ধরে। তারা একটি ফাঁদের মধ্যে ছাগল বেঁধে বাঘটিকে আটকে ফেলে। তারপর চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে বাঘটিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বন বিভাগের সুন্দরবন কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাঘটির গলায় কলার রেডিও পরানো হয়। এরপর বাঘটির সবশেষ অবস্থান ছিল বাংলাদেশে।
কলার রেডিও একটি বিশেষ পর্যবেক্ষণ যন্ত্র। বাঘের অবস্থান, গতিবিধি, জীবনাচরণ প্রভৃতি পর্যবেক্ষণের জন্য কলার রেডিও পরানো হয়।
বাংলাদেশের সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সবশেষ ২০১৭ সালের বাঘশুমারির সময় তোলা ছবির সঙ্গে ভারত থেকে ফিরে আসা বাঘটির ছবি একদফা মিলিয়ে দেখা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ছবির একটি বাঘের গায়ের ডোরাকাটা দাগের সঙ্গে ভারতফেরত বাঘটির মিল পাওয়া গেছে। বিষয়টি আরও নিশ্চিত হতে বন বিভাগের খুলনায় অবস্থিত পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগীয় কার্যালয়ে থাকা বাঘবিষয়ক গবেষণাগারে যাচাই-বাছাই চলছে।
এ ব্যাপারে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘশুমারি করার সময় তোলা ছবির সঙ্গে ভারত থেকে ফিরে আসা বাঘটির ছবি আমরা মিলিয়েছি। ছবির একটি বাঘের সঙ্গে এ বাঘের মিল পাওয়া গেছে।’
আবু নাসের মোহসিন হোসেন আরও বলেন, ভারতীয় বন বিভাগ সুন্দরবনের যে অঞ্চল থেকে বাঘটিকে ফাঁদ পেতে ধরেছিল, সেটি বাংলাদেশ অংশ থেকে বেশ কাছে। আর ওই অংশ দিয়ে বাঘ নিয়মিত বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবনে যাতায়াত করে। ফলে ফিরে আসা বাঘটি বাংলাদেশের বলেই মনে হচ্ছে। ভারতে গিয়ে বাঘটি আবার বাংলাদেশে ফিরে এসেছে।
ভারতের বন বিভাগ ও দেশটির কয়েকজন বিশেষজ্ঞের কাছে বাঘটি সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হয়। তারা নিশ্চিত করেছে, বাঘটি ভারতীয় অংশের সুন্দরবনের নয়। কারণ, ভারতের বন বিভাগের কাছে ভারতীয় সুন্দরবনের সব কটি বাঘের ছবি আছে। তার কোনোটির সঙ্গে বাঘটির কোনো মিল নেই। এ ব্যাপার থেকে তারা মনে করছে, এটি বাংলাদেশের সুন্দরবনের বাঘ। কোনো কারণে বাঘটি ভারতীয় অংশে চলে গিয়েছিল।
এ ব্যাপারে ভারতের বন বিভাগের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য বনপাল (বন্য প্রাণী) বিনোদ যাদব মুঠোফোনে বলেন, ‘বাঘটির সবশেষ অবস্থান বাংলাদেশের সুন্দরবনে দেখা গেছে। তবে এ নিয়ে আমরা আপাতত আর কিছু বলতে চাচ্ছি না।’
তবে বিনোদ যাদব গত সোমবার ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া, বর্তমান ও আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাঘটি যে ভারতের সুন্দরবনের নয়, সেটা তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন।
ভারতের বন বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছরের ডিসেম্বরে কলার রেডিও পরানোর পর বাঘটি চলতি বছরের ১০ মে পর্যন্ত তাদের পর্যবেক্ষণের মধ্যে ছিল। এরপর আর তার অবস্থান পাওয়া যায়নি। কলার রেডিও পরানোর পর পর্যবেক্ষণ সময়ের একটা বড় অংশ বাঘটি বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। অর্থাৎ ভারতে কলার রেডিও পরানোর কয়েক দিনের মধ্যেই বাঘটি বাংলাদেশ অংশে চলে আসে।
ভারতের বন বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাঘটির সবশেষ অবস্থান ছিল তালপট্টি দ্বীপ এলাকায়। যেটি বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার মধ্যে পড়েছে।
ভারতের বন বিভাগের তথ্যমতে, ৮ থেকে ৯ বছর বয়সী বাঘটি গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ১০ মে পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে। বাঘটি তার ভারত-বাংলাদেশ যাত্রাপথে ভারতীয় অংশের ছোট হরিখালী ও বড় হরিখালী নদী অতিক্রম করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের রায়মঙ্গল নদও বাঘটি অতিক্রম করেছে। আর বাঘটির বর্তমান অবস্থান জানা না গেলেও বাঘটি যে বেঁচে আছে, তা নিশ্চিত। কারণ, বাঘটির দেহে একটি বিশেষ ধরনের চিপ আছে। বাঘটি মারা গেলে চিপ থেকে বিশেষ সংকেত পাওয়া যাওয়ার কথা, যা এখনো মেলেনি।
বাঘটি যে পথ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, তা সুন্দরবনের কোন অংশে পড়েছে, সেটি চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশের বন বিভাগ। এখন তারা বাঘটির বর্তমান অবস্থান জানার চেষ্টা করছে।
বাঘ বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল আজিজ বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশে বাঘশুমারির সময় আমরা দেখেছি, দুটি বাঘের ছবি দুই দেশের সুন্দরবনেই পাওয়া গেছে। অর্থাৎ বাঘ দুটি বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবন অংশে ঘোরাফেরা করেছে। এ ধরনের বাঘের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।’
অধ্যাপক আবদুল আজিজ বলেন, কোনো বাঘ তার বসতি এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় গিয়ে ধরা পড়ার পর ছাড়া পেলে সে তার আগের বসতি এলাকায় আবার ফিরে আসে। ফলে ভারতে কলার রেডিও পরানোর পর এখানে ফিরে আসা বাঘটি বাংলাদেশেরই, তা বলা যায়।