দেশে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ রেকর্ড ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ

গাজী আবু বকর : এক মাসের ব্যবধানে দেশে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আর সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে দশমিক ২৩ শতাংশ। তবে একই সময়ে খাদ্য বহির্ভূত খাতে ১ দশমিক ৫২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি কমেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস গত জুলাইয়ে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আগস্টে তা বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। গতকাল রোববার বিবিএস এই তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত আগস্টে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ রেকর্ড ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে পৌঁছেছে। এর আগের মাসে এই খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। বিবিএসের তথ্যানুসারে, গত আগস্টে দেশে খাদ্য বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। জুলাইয়ে তা ছিল ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

উল্লেখ, বিদায়ী অর্থবছরের পুরোটা জুড়েই মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বেশি চাপের মুখে ছিল দেশের সাধারণ মানুষ। এ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতির হার সরকারের লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাপিয়ে যায়। বিবিএসের তথ্যানুসারে, এক যুগের মধ্যে গত অর্থবছর দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ ছিল। গত এক যুগের মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছর দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল সর্বোচ্চ। পরিসংখ্যান বলছে, বার্ষিক হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। হিসাব বলছে, এটি গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১০-১১ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। গড় মূল্যস্ফীতি বাড়লেও মাসিক হিসাবে গত জুন মাসের মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। এ মাসে মূল্যস্ফীতির হার শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশে। যা এর আগের মাস অর্থাৎ মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। যা ছিল ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশ। তবে জুন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুসারে, এ মাসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে উঠে গেছে। যা মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। কাজেই সাধারণ মানুষকে চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। আর খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ, যা জুনে কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশে। এদিকে বার্ষিক হিসাবে গ্রামাঞ্চলের গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। যা ২০২১-২২ অর্থবছর ছিল ৬ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর মাসিক হিসাবে, মে মাসের তুলনায় জুনে গ্রামাঞ্চলের মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে হয়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। যা মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

অন্যদিকে বিদায়ী অর্থবছরে শহরের গড় মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। যা ২০২১-২২ অর্থবছরের ছিল ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর জুনে শহরের মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশে ঠেকেছে। যা মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। তবে জুনে দুই অঞ্চলেরই খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। গ্রামাঞ্চলের এর হার ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ আর শহরে ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। যা মে মাসে ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।

উল্লেখ্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বড় ধরনের মূল্যস্ফীতি হয়েছে বাংলাদেশে। মূল্যস্ফীতি এখন সারা বিশ্বেরই সবচেয়ে বড় সমস্যা। বিশ্বব্যাপী সব ধরনের অর্থনৈতিক নীতি নেয়া হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেড মূল্যস্ফীতি কমাতে আগ্রাসীভাবে নীতি সুদের হার বাড়াচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে মন্দাকে পর্যন্ত ডেকে আনা হচ্ছে। এ নিয়ে এখন বিশ্বব্যাপী চলছে প্রবল বিতর্ক। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, সবাই যদি সমন্বিতভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি না করে, তাহলে মন্দার চেয়েও খারাপ অবস্থা হতে পারে। দেখা দিতে পারে স্ট্যাগফ্লেশন বা বদ্ধস্ফীতি। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি আদৌ কমল না, অথচ প্রবৃদ্ধি কমে গেল ভয়াবহভাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বছরাধিককাল ধরেই দেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রবণতা ছিল। ঠিক এ রকম এক সময়ে, গত বছর ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনের দাম লিটারে ৪৬ টাকা ও পেট্রলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানো হয়। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম এত বাড়ানো হয়নি। এর পরপরই সব ধরনের পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হয়। এই দুইয়ের প্রভাবে বেড়ে যায় প্রায় সব পণ্যের দাম। এরপর গত বছর ২৯ আগস্ট খানিকটা মুখ রক্ষা করতে জ্বালানি তেলের দাম ৫ টাকা কমায় সরকার। তবে তাতে বাজারে খুব একটা প্রভাব দেখা যায়নি। বরং এর সামগ্রিক প্রভাবে খাদ্যপণ্য ছাড়াও যাতায়াত, পোশাক-আশাক, শিক্ষাসামগ্রীসহ খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামও বেশ বেড়ে যায়।

Share