দেহের বয়স বাড়ে, মনের বয়স বাড়ে না : রুনা লায়লা

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ঘড়িতে তখন মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা। নিজ বাসায় সমকালের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলোচনার জন্য সময় বরাদ্দ রেখেছিলেন রুনা লায়লা। তাঁর নামের পাশে কোনো বিশেষণ লাগে না। নামটিই যথেষ্ট। কারণ তিনি একাই একটি অধ্যায়। ৫৮ বছরের বর্ণাঢ্য সংগীতজীবন বাংলাদেশের খুব কম নায়িকাই আছেন, যাঁরা তাঁর গাওয়া গানে ঠোঁট মেলাননি। ১৯৬৪ সালে বাবা সৈয়দ মোহাম্মদ এমদাদ আলীর অনুমতি নিয়ে সাড়ে ১১ বছর বয়সে পাকিস্তানের ‘জুগনু’ চলচ্চিত্রে প্রথম প্লেব্যাক করেন রুনা লায়লা। ‘গুড়িয়াসি মুন্নি মেরি ভাইয়া কি পেয়ারি’ গানটি কণ্ঠে তোলার জন্য টানা দুই মাস তালিম নিয়েছিলেন তিনি।

রুনা লায়লা এ দেশের প্রথম সংগীতশিল্পী, যিনি জয় করে নেন উপমহাদেশের মানুষের হৃদয়। নব্বই দশকে মুম্বাইয়ে পাকিস্তানি সুরকার নিসার বাজমির সুরে এক দিনে ১০টি করে, তিন দিনে ৩০টি গানে কণ্ঠ দিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও নাম লিখিয়েছিলেন তিনি। বাংলা ছাড়া রুনা লায়লা উর্দু, হিন্দি আর ইংরেজি ভাষা জানেন। তবে বাংলা, হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, গুজরাটি, পশতু, বালুচ, আরবি, পারসিয়ান, মালয়, নেপালি, জাপানি, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, ইংরেজিসহ ১৮টি ভাষায় ১০ হাজারেরও বেশি গান করেছেন রুনা লায়লা।

আজ ১৭ নভেম্বর [বৃহস্পতিবার] ৭০ বছরে পা রাখলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই কণ্ঠশিল্পী। ১৯৫২ সালের এই দিনে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আলোচনার শুরুতেই এই কোকিলকণ্ঠী বলেন, ‘আমার জীবনে প্রাপ্তিটাই বেশি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিদেশেও অনেক সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছি। এটি সত্যিই অকল্পনীয়। আমার নিজেরও মাঝেমধ্যে অবাক লাগে, এটি কি আমাকে নিয়েই হচ্ছে! দেশের সাধারণ মানুষের অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পাচ্ছি; যা আমার পাওয়া ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি। নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করি। এখনও গান করছি। আমার শিল্পীজীবনে তৃষ্ণা আছে, অতৃপ্তি নেই।’ একই সঙ্গে বললেন, ‘ব্যর্থতা আমার জীবনে খুব একটা আসেনি। এ জন্য নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করি। গান গাওয়ার জন্য কখনও কাউকে তোষামোদ করতে হয়নি; বরং যত দিন গড়িয়েছে, আমার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। আগামীতেও যে ক’দিন গান করি, মানুষের আগ্রহ যেন থাকে। গানের মাধ্যমেই আমি আমার জীবনকে উপভোগ করি।’

নিজের জন্মদিন প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘এবার ব্যক্তিজীবনে ৭০ বছরে পা দিচ্ছি। কিন্তু মনেপ্রাণে আমি এখনও ১৭ [হাসি], আমি সবসময় বিশ্বাস করি, মানুষের দেহের বয়স বাড়ে, মনের বয়স কখনও বাড়ে না। তাই তো আমার কাছে বয়স শুধু একটা সংখ্যা মাত্র। মনের বয়স কখনোই বাড়তে দিই না। সবকিছুতে আসলে মনের জোরটাই বেশি দরকার।’ তিনি আরও বলেন, ‘এবার জন্মদিন আমার পাশাপাশি পরিবারের সবার জন্যও বিশেষ। অনেকদিন আগে থেকেই তা নিয়ে চলছে নানা পরিকল্পনা। সত্যি বলতে কি, প্রতি বছর জন্মদিন এলে মনে পড়ে মা-বাবার কথা। বড় বোন দীনার কথা। হয়তো সবাই থাকলে জীবনের এই দিনটি আরও বিশেষায়িত হতো। তারপরও যাঁরা আছেন, তাঁদের নিয়েই ভালো থাকাটা জরুরি। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, সুস্থ আছি। সবাই দোয়া করবেন যেন আগামীদিনেও আল্লাহ ভালো রাখেন, সুস্থ রাখেন।’ উপমহাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তির জন্মদিনটি বরাবরের মতো এবারও বিশ্বজুড়ে উদযাপন করবেন তাঁর অগুনতি ভক্ত। একইভাবে এবারের জন্মদিনটিকে বিশেষভাবে উদযাপনের উদ্যোগ নিয়েছে চ্যানেল আই। জন্মদিনে বাড়তি আনন্দ যোগ করতে এবং রুনা লায়লার প্রতি বিশেষ সম্মান জ্ঞাপন করার লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে নতুন একটি গান। যেখানে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা লায়লার চার অনুসারী। তাঁরা হলেন- কোনাল, ঝিলিক, মেজবাহ বাপ্পী ও তরিক মৃধা। তাঁরা প্রত্যেকেই উঠে এসেছেন চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠের মঞ্চ থেকে। একটি কথা প্রচলিত আছে- ‘রুনা লায়লা মানে বাংলাদেশ’। এই বিষয়টি আপনাকে কতটুকু পুলকিত করে? উত্তরে তিনি বলেন, “আমি বাংলাদেশের মেয়ে, এটিই আমার কাছে অনেক গর্বের বিষয়। আমার মাতৃভাষা বাংলা- এটিও আমার জন্য অনেক গর্বের বিষয়। যখন বিদেশের মাটিতে স্টেজ শোর জন্য পা রাখি, মঞ্চে ওঠার আগে যখন উপস্থাপক আমার নাম ঘোষণা করেন, তখন আমি বলে দিই- এভাবে বলেন, ‘রুনা লায়লা ফ্রম বাংলাদেশ’। বাংলাদেশকে বিশ্বে আমার কারণে, আমার গানের কারণে যতটা পরিচিতি করে তোলা যায় সেটি তো আমারই গর্বের বিষয়। আবার দেশের বাইরে যখন এ দেশের গান নিয়ে কথা বলি, তখনও ভালো লাগায় মন ভরে যায়।”

শুধু গানই নয়, তরুণ প্রজন্মের কাছে ফ্যাশন আইকনও তিনি। তাঁর সাজসজ্জা, পোশাক, গাওয়ার ভঙ্গি থেকে শুরু করে সবই অনুসরণ করে তরুণ প্রজন্ম। রুনা লায়লা নিজেও তরুণদের নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। তরুণদের নিয়ে তিনি বলেন, ‘সুযোগ দিলেই তরুণরা নিজেদের প্রমাণ করতে পারবে। এ জন্য সবার উচিত তাদের কথা ভাবনায় রাখা। জানি না, কেন আমাদের এখানে অনেকে নতুনদের সঙ্গে কাজ করতে ভয় পায়। ওদের সুযোগ না দিলে প্রমাণ করবে কীভাবে? আমিও বলি, ওদের দিয়ে গাওয়ান। ওদের তৈরি করতে হবে। সে জন্য যতটা পারি তরুণদের খোঁজ নিই। গানের বিষয়ে পরামর্শ দিই। আর সুরকার হিসেবে যখন কাজ করছি, তখন গুণী শিল্পীদের নিয়ে যেমন কাজ করেছি, তেমনি নতুন শিল্পীদের নিয়েও কাজ করছি।’

সবশেষে জানতে চাই আপনাকে শিল্পী হিসেবে না পেলে কীভাবে পেতাম? উত্তরে রুনা লায়লা বলেন, ”আমাকে শিল্পী ছাড়া আর কোনোরূপেই পাওয়া যেত না। আমি মনে করি, আমার জন্মই হয়েছে গানের জন্য। গান ছাড়া আমি আর কিছুই পারি না। শিল্পী, শিল্পী এবং শিল্পী-এর বাইরে আর কিছুই নই। আর আমার গানের মতোই বলতে চাই- শিল্পী আমি তোমাদেরই গান শোনাবো/তোমাদেরই মন ভরাবো/শিল্পী হয়ে তোমাদেরই মাঝে চিরদিন আমি রবো।”

Share