ধর্ষণের শিকার প্রবাসী নারী কর্মীর সন্তান নিয়ে ফেরাদের দুঃসহ জীবন

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : ছয় মাস বয়সী সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে এসেছেন। এই জীবনে তিনি আর তাঁর সন্তানের মুখ দেখতে পাবেন না, এমন শর্তে রাজি হয়ে নিজের সন্তানকে দিয়ে দেওয়া এই নারী বললেন, ‘আমি ছেলেরে না দিয়া কী করুম? ওরে নিয়া কই যামু? স্বামী তালাক দিলে বাড়িতে মায়ের কাছে দুই ছেলেরে রাইখ্যা বিদেশ গেছিলাম। এখন ফিরছি সৌদিতে যে বাড়িতে কাজ করতাম ওই বাসার মালিকের ছেলের সন্তান নিয়া। এই কথা তো কাউরে বলাও যায় না।’

আদালতের মাধ্যমে এই নারী শিশুটিকে অন্য একটি পরিবারের কাছে তুলে দিয়েছেন। মা, তাই ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া এই সন্তানের প্রতি মায়া জন্মে গেছে তাঁর। এই নারী ধর্ষণ–নির্যাতনের বিচার পাননি। দেশে ফিরে এক অনিশ্চিত পথে পা হাঁটছেন তিনি।

গত ৮ জুন দেশে ফিরে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সন্তান নিয়ে বসে ছিলেন। বিমানবন্দরে কর্মরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের কাছে দেওয়া হয় এই নারীকে। গত বছরের নভেম্বর মাসে তিনি সৌদি আরব গিয়েছিলেন।

সৌদি আরবে জেলখানায় সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছেন—এ তথ্য পুরোটাই গোপন করে ১১ জুন তিনি নিজ বাড়ি ফেরেন। এ তথ্য গোপন করতে না পারলে তিনি পরিবার বা সমাজে টিকতে পারবেন না বলে জানান।

শুধু এই নারী নন গত কয়েক বছরে বিদেশে চাকরি করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার, পরে সন্তান নিয়ে দেশে ফিরেছেন বেশ কয়েকজন নারী। ব্র্যাক এমন ১২ জন নারীকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিচ্ছে। আর ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড সন্তানসহ দেশে ফেরা ১৫ জন নারী শ্রমিকের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। তবে কতজন নারী কাজ করতে গিয়ে সন্তান নিয়ে ফিরেছেন, সেই তথ্য কোথাও সংরক্ষণ নেই।

সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে গৃহকর্মীসহ বিভিন্ন কাজের জন্য যাওয়া নারীদের কেউ কেউ সন্তান পেটে নিয়ে বা সন্তান কোলে নিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। দেশে ফেরার পর পিতৃপরিচয় ছাড়া এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মা ছাড়া এই সন্তানেরা বেড়ে উঠছেন।

বিমানবন্দরের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন (কয়েক দিন আগে পদোন্নতি পেয়ে অন্য বিভাগে বদলি হয়েছেন) বলেন, সন্তানসহ নারী শ্রমিক ফিরে এলে তার আলাদা পরিসংখ্যান সেভাবে রাখা হয় না। কোনো নারী সন্তান ফেলে গেলে বা সঙ্গে নিতে না চাইলে তখন বিষয়টি আলোচনায় আসে। তিনি তাঁর কাজের অভিজ্ঞতায় বললেন, গত প্রায় তিনি বছরে বিভিন্ন কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেরত আসা শতাধিক নারী শ্রমিককে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করেছেন।

ব্র্যাকের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে শুধু সৌদি আরব থেকে ফিরছেন ১০ থেকে ১২ হাজার নারী। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসা নারীদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছরে সমস্যার মধ্যে থাকা নারীদের মধ্যে ২ হাজার ৩৩৬ জন নারী আউট পাসের মাধ্যমে দেশে ফিরেছেন। ২০২০ সালে আউট পাস ও পাসপোর্ট নিয়ে ফিরেছেন ৫০ হাজার ৬১৪ জন নারী শ্রমিক।

গত ২ এপ্রিল বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল বেল্টের পাশ থেকে আট মাসের একটি মেয়েশিশুকে উদ্ধার করেন এপিবিএনের সদস্যরা। আগের দিন রাতে সৌদি এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজে শিশুকে নিয়ে ফেরা ওই নারী সারা রাত অ্যারাইভাল বেল্টের পাশে বসেছিলেন। সকালে আর সেই মাকে পাওয়া যায়নি। এই শিশুর আশ্রয় মিলেছে সরকারের ছোটমণি নিবাসে।

২০১৭ সালে জর্ডান থেকে ফেরা এক নারী শ্রমিকও বিমানবন্দরে সন্তান ফেলে চলে গিয়েছিলেন। আদালতের মাধ্যমে ওই শিশু পরে নতুন বাবা-মা পেয়েছিল।

মানিকগঞ্জের এক কিশোরী জর্ডানে কাজের জন্য গিয়ে বাংলাদেশি দালালের খপ্পরে পড়ে। পরে সে যৌনকাজ করতে বাধ্য হয়। এই কিশোরী মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ছয় মাসের সন্তান পেটে নিয়ে দেশে ফিরেছিল। সম্প্রতি এই নারীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সন্তানের বয়স প্রায় তিন বছর হতে চলেছে। এই মা এখন আর কিশোরী নেই। বললেন, ‘বিদেশ গিয়া কোনো লাভ তো হইলই না, মাঝখান থেকে জীবনটাই শেষ হইয়্যা গেল।’

বিদেশফেরত এই নারীরা সরকারিভাবে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই বিদেশ গিয়েছিলেন। কিন্তু ফিরে আসার পর সরকার, রিক্রুটিং এজেন্সি কেউ এই নারীদের দায় নিচ্ছে না। আর বেসরকারি সংস্থা বলছে নানা সীমাবদ্ধতার কথা। দেশে ফিরে কোনো কোনো নারী আত্মহত্যা করারও চেষ্টা করেছেন। এলাকায় জানাজানির পর কেউ কেউ বাসা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন।

সন্তান নিয়ে দেশে ফেরা এক নারী আলাপকালে বলেন, বাড়ির মালিকের ছেলে তাঁকে ধর্ষণ করছে এ কথা ছেলের মা–বাবাকে জানাতে পারছিলেন না। ছেলে ইশারা–ইঙ্গিতে ভয় দেখিয়েছিলেন, কাউকে ঘটনার কথা জানালেই তাঁকে মেরে ফেলবেন। একপর্যায়ে না জানিয়ে আর উপায় ছিল না। জানানোর পর পেটের বাচ্চাকে মেরে ফেলার জন্য আনারসের জুস খাওয়ানো, বড় বড় জাজিম বা তোশক নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করানো, সিঁড়ি থেকে ফেলে দেওয়াসহ বিভিন্ন চেষ্টাই করেছেন ছেলের মা। শেষ পর্যন্ত বাড়ির মালিক জেলখানায় পাঠিয়ে দেন। দুই মাস জেলে থাকতে হয়। জেলখানাতেই সন্তানের জন্ম। আদালতে বা চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সময় এই নারীকে হাত ও পায়ে হাতকড়া পরানো হতো। সে যন্ত্রণার কথা এখনো অনুভব করেন এই নারী।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, নারীদের বিদেশে পাঠানো বন্ধ করা যাবে না। তবে যে নারীরা যাবেন এবং বিভিন্ন কারণে দেশে ফিরতে বাধ্য হবেন তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নির্যাতনের শিকার নারীরা ওই দেশে থাকা অবস্থাতেই দূতাবাসের মাধ্যমে সন্তানের পিতৃত্ব নির্ণয়ে ডিএনএ টেস্ট করাতে হবে। অনেক সময় গৃহকর্মীর বাড়ির মালিক বা ছেলের পাশাপাশি বাড়িতে থাকা অন্য কেউ, বাংলাদেশি দালাল এমনকি দূতাবাসে কর্মরতদের বিরুদ্ধেও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া যায়। তাই অভিযুক্ত যে–ই হোক তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

সন্তান নিয়ে ফেরত আসা এক নারী বলছিলেন, তিনি সৌদি আরবের যে দুটি জেলখানায় ছিলেন। সেখানে সন্তানসহ অন্য বাংলাদেশি নারীরাও ছিলেন। ওই নারীরাও দেশে ফিরতে চান।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপপরিচালক জাহিদ আনোয়ার প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ‘বিশেষ কেস বিবেচনায় বিমানবন্দর এবং বেসরকারি সংগঠনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ ধরনের মোট ১৫ জন নারীর প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থানসহ সার্বিকভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিচ্ছে। পুনর্বাসনের আওতায় ওই নারীরা যে দেশ থেকে ফেরত এসেছেন, ওই দেশের দূতাবাসকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়ে চিঠি পাঠানো হবে।’

বেসরকারি সংস্থা অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের চলতি বছরের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত ‘অ্যাকসেস টু জাস্টিস ফর বাংলাদেশি মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স: অপরচুনিটিজ অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, ফরিদপুর, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের ২৬২ জন ফেরত আসা নারী শ্রমিকের মধ্যে ৬০ শতাংশ বিভিন্ন রকম নির্যাতনের শিকার এবং এদের ১৬ শতাংশই বিদেশে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নমিতা হালদার বললেন, সরকারকেই ফেরত আসা নারীর দায়দায়িত্ব নিতে হবে। সৌদি আরব সরকারকেও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আর ছাড় দেওয়ার সময় নেই।

চলতি বছরের ২৬ মার্চ সৌদি আরব থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সন্তান নিয়ে দেশে ফেরেন নরসিংদীর এক অবিবাহিত নারী। ২৩ জুন মুঠোফোনে এই নারীর বড় বোনের সঙ্গে কথা হয়। জানালেন, দেশে ফেরার পরপরই বাচ্চাটিকে অন্য একজনের কাছে দিয়ে দিয়েছেন। দীর্ঘদিন তাঁর বোনকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন, তাতে পা ফুলে যায়। এখন শিকল খুলে দিয়েছেন। তবে তিনি সবাইকে গালাগালি করেন বলে আশপাশের লোকজন বিরক্ত হন।

এই বড় বোন বললেন, ‘আমরা নিষেধ করছিলাম বিদেশ যাইতে। শুনে নাই। সুস্থ মানুষ বিদেশ গেল, ফিরল পাগল হয়ে। সরকার মেয়েদের বিদেশ যাওন ডাইরেক্ট বন্ধ কইরা দিক।’

এই নারীর মা মারা গেছেন। বাবা বৃদ্ধ। ভাই–বোনদের নিজেদের সংসার আছে। ওই নারীকে দেখার কেউ নেই।

সৌদি থেকে দেশে ফেরত আসা এক নারীর মানিকগঞ্জের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ওই নারী তাঁর বাবা, মা, সন্তানসহ অন্যদের নিয়ে তাঁর নানির ঘরে ভাগাভাগি করে থাকেন। বাবা মাটি কাটার কাজ করেন। করোনায় কাজ পাচ্ছেন না প্রায় সময়ই। এই বাবা বললেন, ‘মাইয়্যা যে এই অবস্থায় বিদেশ থেকে ফিরব, তা কল্পনাও করি নাই। পুরাই পাগলা হইয়া ফিরছে, আমি বাপ হইয়াও তার কোনো কথাই বুঝতে পারি না। যে সন্তান নিয়া আসছে সেও বড় হইতাছে। আমি আমার নিজের পোলাপাইনের মুখেই খাবার দিতে পারি না, আরেকজনের বাচ্চারে খাওয়ামু কেমনে? প্রথম দিকে অনেকেই খবর নিত, এখন তো ভুইল্যা গেছে সবাই।’

বাবা জানালেন, মেয়েকে বিয়েও দিতে পারছেন না। বললেন, ‘মাইয়্যার ভবিষ্যৎ তো শ্যাষই, আমাগোর ভবিষ্যৎও শ্যাষ হইয়া গেছে।’

অবিবাহিত এক নারী গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মরিশাসে পোশাক কারখানায় কাজের জন্য যান। গত বছরের ডিসেম্বর মাসেই দেশে ফিরতে বাধ্য হন। তিনি যে গার্মেন্টসে কাজ করতেন তার মালিকের সঙ্গে হাত মেলান বাংলাদেশি কয়েকজন দালাল। অচেতন করে ধর্ষণ করেন মালিক, তা ভিডিও করে রাখেন বাংলাদেশি দালালেরা। ভিডিও ফুটেজের ভয় দেখিয়ে তাঁরাও ধর্ষণ করেন। এই নারী অন্তঃসত্ত্বা হলে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে সন্তান নষ্ট করতে বাধ্য (গর্ভপাত) করা হয় বলে এই নারীর অভিযোগ।

মুঠোফোনে এই নারী বললেন, ২০ জুন লিখিতভাবে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বরাবর বিচার চেয়ে লিখিত আবেদন করেছেন তিনি। লিখিত আবেদনে কোন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে তিনি বিদেশ গিয়েছিলেন, মালিকের নাম, বাংলাদেশি দালালদের নাম, পরিচয়—সবই বিস্তারিতভাবে লিখেছেন।

সন্তান নিয়ে দেশে এক নারীর বাবা বললেন, মেয়ে ফেরার পর কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা দাঁড়িয়েছিল। গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচারের পর স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছিল। কিছু আর্থিক সহায়তাও পাওয়া যায়। কিন্তু একসময় তো সহায়তা আর আসে না। এ নিয়ে গণমাধ্যমে কথাও হয় না। যে পরিবারের ঘটনা দায়টা কেবল তাদের ওপরই আসে। তিনি বলেন, বিদেশে কাজের জন্য তো গরিব ঘরের মেয়েরাই যায়। একটা বাচ্চা নিয়ে ফিরে আসার পর মেয়েটির কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না। মেয়ের কাজ নেই। অথচ আরও একজনের খাবার জোগাড় করতে হচ্ছে।

Share