নয়াবার্তা প্রতিবেদক : নতুন করে দেশি-বিদেশি আরও চার ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। ফলে গত জুন শেষে দেশে মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন করে যে চারটি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে সেগুলো হলো নতুন প্রজন্মের বেসরকারি বেঙ্গল ব্যাংক ও সিটিজেনস ব্যাংক এবং বিদেশি মালিকানাধীন হাবিব ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। চারটি ব্যাংকে গত মার্চ শেষেও মূলধন উদ্বৃত্ত ছিল।
ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় তাতে ব্যাংকগুলোর প্রভিশনিং বা নিরাপত্তা সঞ্চিতিও বাড়ছে। ফলে কোনো কোনো ব্যাংকে নতুন করে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আবার আগে থেকে ঘাটতি থাকা কিছু ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি আরও বেড়েছে।
আমানতকারীদের অর্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যাংকিংয়ের আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, সব ব্যাংককে একটি নির্দিষ্ট হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের অর্থ ও প্রতিবছরের মুনাফা থেকে এ মূলধন সংরক্ষণের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মূলধন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুসরণ করা হয়। ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বা রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেটের ১০ শতাংশ বা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি, সেই পরিমাণ মূলধন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যেসব ব্যাংক এ নীতিমালা অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে পারে না, সেসব ব্যাংককে মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মূলধন ঘাটতিতে থাকা সেসব ব্যাংক শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুন শেষে যে ১৫টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে তার মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ৫টি, বেসরকারি খাতের ব্যাংক ৬টি, বিদেশি মালিকানাধীন ব্যাংক ২টি ও বিশেষায়িত ব্যাংক ২টি। জুন শেষে এ ১৫ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। গত মার্চে মূলধন ঘাটতিতে ছিল ১১টি ব্যাংক। ওই ১১ ব্যাংকের সম্মিলিত ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৩ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে ১৬৯ কোটি টাকা। আর ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে ৪।
গত জুন শেষে মূলধন ঘাটতিতে থাকা রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো হলো অগ্রণী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক। বেসরকারি খাতের ছয় ব্যাংক হলো বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, বেঙ্গল ব্যাংক, সিটিজেনস ব্যাংক, আইসিবি, ন্যাশনাল ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক। এর মধ্যে বেঙ্গল ও সিটিজেনস ব্যাংক নতুন করে গত জুন শেষে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে হাবিব ব্যাংক ও ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং বিশেষায়িত ব্যাংকের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। জুন শেষে ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫ হাজার ৫৪১ কোটি টাকায়। গত মার্চ শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ হাজার ৯৪ কোটি টাকা।
নতুন করে যে চারটি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি দেখা দিয়েছে সিটিজেনস ব্যাংকের। জুন শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯৭ কোটি টাকার বেশি। অথচ মার্চ শেষে ব্যাংকটির প্রায় ৩ কোটি টাকা মূলধন উদ্বৃত্ত ছিল। এ ছাড়া জুন শেষে বেঙ্গল ব্যাংক, হাবিব ব্যাংক ও ব্যাংক অব পাকিস্তানের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৮৮, ৩৬ ও সাড়ে ৪২ কোটি টাকায়।
এদিকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে ঘাটতিতে থাকলেও সোনালী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো করেছে সোনালী ব্যাংক। গত মার্চ শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা, জুনে তা কমে ১১ কোটি টাকায় নেমেছে। আর জনতা ব্যাংকের ঘাটতি প্রায় ২০০ কোটি টাকা কমে জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি কমেছে প্রায় ৩৪৪ কোটি টাকা। জুন শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৩০ কোটি টাকা।
মূলধন ঘাটতিতে পড়া ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জুন শেষে ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত উদ্বৃত্ত মূলধনের পরিমাণও কমে গেছে। গত মার্চ শেষে সম্মিলিতভাবে ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত মূলধনের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা, জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ বাড়তে থাকবে। এতে সক্ষমতা হারাবে ব্যাংকগুলো। আর মূলধন ঘাটতি যত বাড়তে থাকবে, আমানতকারীদের আমানতের ঝুঁকিও তত বাড়বে।