নতুন যুগে যুক্তরাজ্যের রাজতন্ত্র

এএফপি : নতুন যুগে প্রবেশ করেছে যুক্তরাজ্যের রাজতন্ত্র। ৭০ বছর পর নতুন রাজা পেয়েছে সে দেশের মানুষ। রাজা তৃতীয় চার্লস (চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জ) আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেছেন। গতকাল শনিবার জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাঁর অভিষেক হয়েছে।

একই দিনে রানি (কুইন কনসোর্ট) হিসেবে অভিষেক হয়েছে রাজা তৃতীয় চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলারও (ক্যামিলা রোজম্যারি সান্ড)। যুক্তরাজ্যের সময় দুপুর ঠিক ১২টা ২ মিনিটে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে রাজা চার্লসের মাথায় নিখাদ সোনার সেইন্ট এডওয়ার্ড মুকুট পরিয়ে দেন ক্যান্টারবুরির আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি। এই মুকুটকে যুক্তরাজ্যের রাজতন্ত্রের পবিত্র ও প্রাচীন স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের ৭০ বছর পর এই মুকুট পরলেন রাজা তৃতীয় চার্লস। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রানির মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে চার্লস যুক্তরাজ্যসহ ১৬টি দেশের রাজা হন।

মুকুট পরে সিংহাসনে : ক্যান্টারবুরির আর্চবিশপ রাজার মাথায় সেইন্ট এডওয়ার্ড মুকুট পরিয়ে দেওয়ার পর উপস্থিত লোকজনের মধ্য থেকে সমস্বরে আওয়াজ ওঠে, ‘ঈশ্বর, রাজাকে রক্ষা করুন।’ ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার এই আবহের মধ্যেই বেজে ওঠে ট্রাম্পেট (বাদ্যযন্ত্র)। অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে ১৩টি স্থান থেকে রাজাকে দেওয়া হয় গান স্যালুট।

মুকুট পরিয়ে দেওয়ার পর শুরু হয় সিংহাসনে আরোহণের পর্ব। ক্যান্টারবুরি ও ইয়র্কের আর্চবিশপ এবং তাঁদের সহকারীরা রাজাকে সিংহাসনের দিকে নিয়ে যান। এরপর সিংহাসনে বসেন রাজা তৃতীয় চার্লস। মাথায় মুকুট পরিয়ে দেওয়া ও সিংহাসনে আরোহণের আনুষ্ঠানিকতা ছিল রাজ্যাভিষেকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মূল অংশ। যুক্তরাজ্যের যেকোনো রাজা বা রানি জীবনে একবারই এই মুকুট পরার সুযোগ পান। প্রথামাফিক রাজা চার্লস ঘণ্টাখানেক মুকুট পরে ছিলেন।

সর্বশেষ ১৯৫৩ সালে নিজের রাজ্যাভিষেকে সেইন্ট এডওয়ার্ড মুকুটটি পরেছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এই মুকুট ১৬৬১ সালে তৈরি করা হয়েছিল রাজা দ্বিতীয় চার্লসের জন্য। অ্যাংলো-স্যাক্সন রাজা ও সেইন্ট এডওয়ার্ড দ্য কনফেসরের নামানুসারে মুকুটটির নাম দেওয়া হয়েছে।

যেভাবে রাজার শপথ : এর আগে যুক্তরাজ্যের রাজতন্ত্রের ৪০তম সিংহাসন আরোহী হিসেবে শপথ নেন রাজা তৃতীয় চার্লস। ক্যান্টারবুরির আর্চবিশপ শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, রাজ্যাভিষেক শপথের আইনি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

রাজাকে আর্চবিশপ বলেন, নতুন রাজা যেন তাঁর শাসনকালে আইনের শাসন ও চার্চ অব ইংল্যান্ডের মর্যাদা সমুন্নত রাখেন।

এ সময় রাজা তৃতীয় চার্লস পবিত্র গসপেলে হাত রেখে আইনের শাসন ও চার্চ অব ইংল্যান্ডের মর্যাদা সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া একজন ‘একনিষ্ঠ প্রোটেস্ট্যান্ট’ হিসেবে দ্বিতীয় শপথও নেন রাজা চার্লস।

শপথ অনুষ্ঠানে বাইবেল থেকে পাঠ করেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। অভিবাসী মা-বাবার সন্তান হিসেবে তিনিই প্রথম যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। রাজ্যাভিষেকের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গৌরবময় অভিব্যক্তি।’

ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে জমকালো পোশাক আর রাজকীয় স্মৃতিচিহ্নের সঙ্গে খ্রিষ্টীয় প্রার্থনার মিশেলে আয়োজনের বেশির ভাগই ছিল উদ্‌যাপনমূলক। তবে প্রথমবারের মতো এবার অভিষেকের দিনে সর্বস্তরের মানুষের জন্য রাজার প্রতি আনুগত্য জানিয়ে শপথ নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা হলেও অনেকেই রাজার প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন।

এর আগে রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে পৌঁছান রাজা তৃতীয় চার্লস (৭৪) এবং তাঁর স্ত্রী ক্যামিলা (৭৫)। বাকিংহাম প্যালেস থেকে একটি ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বৃষ্টিস্নাত শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে তাঁরা ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে পৌঁছান।

রানি ক্যামিলারও অভিষেক : রানি হিসেবে গতকাল অভিষেক হয়েছে চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলারও। তাঁকেও মুকুট পরিয়ে দেন ক্যান্টারবুরির আর্চবিশপ। ক্যামিলাকে পরানো হয় রানি মেরির মুকুট। এরপর অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ প্রার্থনা। অবশ্য ক্যামিলার মুকুট পরানোর অনুষ্ঠান ছিল সাদামাটা। তাঁকে শপথও নিতে হয়নি।

বাবাকে চুমু উইলিয়ামের : রাজা তৃতীয় চার্লস আনুষ্ঠানিকভাবে সিংহাসনে আরোহণ করলে উত্তরসূরি হিসেবে বড় ছেলে প্রিন্স উইলিয়াম তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন। প্রথা অনুযায়ী নতুন রাজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ডান হাতে চুমু খেয়ে শ্রদ্ধা জানান তিনি। অবশ্য বাবা রাজা চার্লসের গালেও চুমু খেতে দেখা যায় উইলিয়ামকে। শপথের আগে বাবাকে বিশেষ রাজকীয় পোশাক পরিয়ে দিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের সিংহাসনের পরবর্তী এই উত্তরাধিকারী।

অবশ্য রাজা চার্লসের ছোট ছেলে প্রিন্স হ্যারি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও আনুগত্যের শপথ নেননি। তাঁকে অনুষ্ঠানে অতিথিদের তৃতীয় সারিতে বসতে দেখা যায়। রাজপরিবারে একমাত্র ডিউক হিসেবে আনুগত্যের শপথ নেন শুধু উইলিয়ামই। আয়োজন শেষে বিএমডব্লিউ গাড়িতে চড়ে প্রিন্স হ্যারিকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে ছাড়তে দেখা যায়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না হ্যারির স্ত্রী মেগান মার্কেল ও তাঁদের সন্তানেরাও।

গতকাল অভিষেক অনুষ্ঠানে ছিলেন বিভিন্ন দেশের রাজপরিবারের সদস্যরাও। বিভিন্ন অঙ্গনের তারকাদের পাশাপাশি নানা ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখা ও মানবিক কাজে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

এ ছাড়া অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেন বিশ্বের শতাধিক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এর আগে গত শুক্রবার মার্লবরো হাউসে কমনওয়েলথ দেশগুলোর নেতাদের দ্বিবার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাজতন্ত্রবিরোধী বিক্ষোভ, আটক : রাজা চার্লসের রাজ্যাভিষেকের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে রাজতন্ত্রবিরোধী সংগঠন রিপাবলিক। তারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান চায়। রিপাবলিক বলেছে, তাদের ছয় সংগঠককে আটক করা হয়েছে। অন্যদিকে পরিবেশবাদী অ্যাকটিভিস্টরা বলেছেন, বিক্ষোভকালে তাঁদের ১৯ জনকে আটক করা হয়েছে। অন্যান্য সংগঠনের কর্মী মিলিয়ে সর্বমোট ৫২ জন বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়।

রাজা তৃতীয় চার্লসের শোভাযাত্রার পথের পাশে ব্যানার-ফেস্টুন উঁচিয়ে রিপাবলিকের বেশ কিছু কর্মীকে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। তাতে লেখা ছিল, ‘আমার রাজা নন’। গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ‘এমন কিছু আপনি মস্কোয় (রাশিয়ার রাজধানী) আশা করতে পারেন, লন্ডনে নয়।’

ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের আনুষ্ঠানিকতা শেষে স্বর্ণখচিত ঘোড়ার গাড়িতে করে শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে বাকিংহাম প্যালেসে ফিরে যান রাজা চার্লস ও রানি ক্যামিলা। এ সময় শোভাযাত্রার দুই পাশে দাঁড়িয়ে পতাকা নেড়ে তাঁদের অভিবাদন জানান ভক্তরা।

রাজা-রানি বাকিংহাম প্যালেসে পৌঁছালে গতকালের আয়োজনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা প্রাসাদের বাগানে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন। পরে প্রাসাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফ্লাইপাস্ট (উড়োজাহাজের মহড়া) উপভোগ করেন নতুন রাজা ও রানি। এ সময় তাঁরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেখানে জড়ো হওয়া হাজারো ভক্তের অভিবাদনের জবাব দেন। তাঁদের সঙ্গে বারান্দায় রাজপরিবারের সদস্যদেরও দেখা যায়।

Share