নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, ঠিকাদার মোগল জি কে শামীম, সাবেক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, মহাপ্রতারক মোহাম্মদ সাহেদের পর এখন আলোচনায় মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির। গত বছর শুরু হওয়া ধারাবাহিক অভিযানে এমন একেকটি নাম যখন সামনে আসে, তখন তাদের উত্থান ঘিরে চমকপ্রদ তথ্যও মেলে। যদিও গ্রেপ্তারের আগে সমাজে দাপট নিয়েই ঘুরে বেড়ান তারা। অনেকেই একাধিক দেহরক্ষী নিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করেছিলেন। গ্রেপ্তারের পর এমন দুর্নীতিবাজদের কোটি কোটি টাকার ‘মসনদ’ তছনছ হলেও যারা তাদের ‘সৃষ্টি’ করেছিলেন, তারা থেকে যান অধরা।
এমনকি চুনোপুঁটি থেকে তাদের যারা অল্প সময়ের মধ্যে বাড়ি-গাড়ি ও শত শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনে সহায়তা করেছেন, অধিকাংশ সময় তাদের টিকিটিও স্পর্শ করা যায় না। অভিযোগ আছে- আলোচিত-সমালোচিত এসব ব্যক্তির নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিতে নানা পর্যায়ের প্রভাবশালী মহল থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়। তাদের জন্য এসব দুর্নীতিবাজ হলো ‘সোনার ডিম’ পাড়া হাঁস। দুর্নীতির অর্থের কমিশন, দামি উপহার ও বিদেশ ভ্রমণের সব খরচপাতির বিনিময়ে প্রশাসনের অনেক অসাধু কর্মকর্তা ‘গোল্ডেন মনির’দের মতো স্বর্ণ চোরাকারবারিদের খোলস বদলাতে সহায়তা করেন। সর্বশেষ গত শুক্রবার গোল্ডেন মনির গ্রেপ্তার হওয়ার পর এখন অনেকের প্রশ্ন- এর পর কে? হয়তো পরে আরেকজন গ্রেপ্তার হবেন। কিন্তু তার নেপথ্য কারিগর থেকে যাবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেখা যাবে, এক সময় আরেকজন ‘গোল্ডেন মনির’ তৈরি করতে সহায়তা করবেন সেই গডফাদার!
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, যারা অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল তারা তো একা করেনি। নেপথ্যে অনেকে সহায়তা করেছেন। সেই নেপথ্য কারিগরদের খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু অতীতে দেখা গেছে, এসব দুষ্টচক্রের নেপথ্যে যারা রয়েছে, তারা গ্রেপ্তার হচ্ছে না। তারা গ্রেপ্তার না হওয়ায় একটা হতাশা তো থেকেই যায়। তবে এটাও ঠিক, প্রশাসনের অসাধু যারা দুর্নীতিবাজদের সহায়তা করছে, তথ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে তাদের অপরাধ সামনে আনা কঠিন।
বছর ছয়েক আগে গুলশানের বাসা থেকে চোরাই স্বর্ণ কারবারের হোতা সালেহ আহমেদকে গ্রেপ্তারের জন্য ফাঁদ পাতে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। চূড়ান্ত অভিযান চালাতে গিয়ে প্রশাসনের এক বড় কর্মকর্তা ও আরেক কর্মকর্তার ভাইয়ের তদবির আসা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সঠিক সময়ে অভিযান চালাতে ব্যর্থ হয় ওই সংস্থাটি। পরে গ্রেপ্তার করা গেলেও বিলম্বে অভিযানের সুযোগ নিয়ে স্যুটকেস ও ব্যাগভর্তি করে চোরাই স্বর্ণ এক আত্মীয়ের বাসায় সরিয়ে ফেলেন সালেহ। এর পাশাপাশি গুলশানে তার বাসায় থাকা কোটি কোটি টাকা ও বিদেশি মুদ্রাও সরিয়ে ফেলার সুযোগ পান তিনি। কথিত আছে, শুধু অভিযান চালাতে বিলম্ব হওয়ার এই সুযোগ যে দু’জন তাকে করিয়ে দিয়েছেন, তাদের মধ্যে একজনকে নগদ অর্ধকোটি টাকা দিয়েছিলেন ধনকুবের সালেহ। পরে সালেহ ধরা পড়ছেন। দুই বছরের মতো কারাভোগ করে বর্তমানে প্রকাশ্যে এসে আবার পুরোনো কারবার শুরু করেন তিনি। বর্তমানে দেশের একটি অন্যতম বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক ও তার ছেলের কালো টাকা অবৈধভাবে বিদেশ পাঠাতে সহায়তা করছেন স্বর্ণ চোরাচালানের শিরোমণি সালেহ। মতিঝিলে মধুমিতা সিনেমা হলের উল্টো পাশের একটি অফিসে নিজের আস্তানা গড়েছেন তিনি।
স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত এমন আরেকজন হলেন রিয়াজ উদ্দিন। তিনি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক। স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৫ সালের আগস্টে রিয়াজ উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তার গ্রেপ্তারের পরও একাধিক প্রভাবশালী মহল থেকে নানা তদবির আসা শুরু হয়।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এমন অনেক দুর্নীতিবাজের তথ্য তাদের কাছে থাকে, চাইলে যে কোনো সময় তাদের আইনের আওতায় নেওয়া যায়। কিন্তু কিছু সময় ওই টার্গেট করা ব্যক্তিকে ধরতে গিয়ে তারা দেখেন, তার সঙ্গে সমাজের প্রভাবশালী অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রভাবশালীদের সঙ্গে তার প্রচুর ছবিও রয়েছে। অনেক সময় তাকে স্টাডি করতে গিয়ে প্রচুর সময়ক্ষেপণ হয়। সব আমলেই দুর্নীতিবাজরা অসাধু প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করেই কারবার চালিয়ে যান।
সংশ্নিষ্টরা আরও বলছেন, সাহেদ, সাবরিনা, গোল্ডেন মনিরদের পাশাপাশি তাদের পেছনের পৃষ্ঠপোষকদের শনাক্ত করে সামনে আনতে হবে। যারা তাদের সহায়তা দিয়ে আসছিল, তারা অনেক বড় অপরাধী। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল চেয়ারে বসে এসব দুর্নীতিবাজকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। তারাই মূলত এসব দুর্নীতিচক্রের ক্রীড়নক। এসব ক্রীড়নককে চাকরিচ্যুতির পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও করা যেতে পারে।
সংশ্নিষ্ট অনেকে বলছেন, গোল্ডেন মনিররা হাজার কোটি টাকার মালিক। তারা এক দিনে তৈরি হননি। তাদের সৃষ্টির ইতিহাস দীর্ঘ। টাকার পাহাড়ে চড়ে জীবনের কালো অধ্যায় পুরোটাই বদলে ফেলেছেন অনেকে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকে জানেন না কীভাবে প্রতারণা ও দুর্নীতি করে তারা বিত্তভৈববের মালিক হয়েছেন। আবার নিজের সাম্রাজ্য অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রশাসনসহ প্রভাবশালী অনেককে প্রায়ই দামি উপহার পাঠাতেন। অনেক কর্মকর্তা তার কাছ থেকে গাড়ি উপঢৌকন হিসেবে নিয়েছেন। চোরাচালান নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে একবার মনিরের বাড্ডার কার্যালয়ে গুলি করা হয়। এর পর অনেক দিন পুলিশ প্রটোকল নিয়ে চলতেন তিনি। বাড্ডা থানার অনেক ওসি তার কাছে ‘অনৈতিক’ সুবিধা নিতেন বলে জানা গেছে।
সংশ্নিষ্ট একজন জানান, অনেক মামলার তদন্ত করে আসামিদের অন্য সহযোগীদের আদ্যোপান্ত বের করা হয়। তবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন, তাদের সহযোগীরা শনাক্ত হওয়ার নজির খুব বেশি নেই। গোল্ডেন মনির গ্রেপ্তার হলেও রাজউক ও গণপূর্তে তার অপকর্মের সঙ্গীরা আইনের আওতায় আসবেন কিনা- সে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, গোল্ডেন মনিরের আরেক সহচর ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল ওরফে সোনা শফিক বছরসাতেক আগে ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হন। তখনও তার ব্যাপারে নানা তদবির আসে। গোল্ডেন মনির গ্রেপ্তারের পর গা-ঢাকা দিয়েছেন শফিক।
গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এ ধরনের অভিযানের পর অনেক দুর্নীতিবাজের সাম্রাজ্যের পতন হয়। ওই বছর ৭ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুদ্ধি অভিযান চালানোর নির্দেশনা আসে। এর পর দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। ওই সভায় যুবলীগের দুই নেতার সমালোচনা করা হয়। এর পর প্রথম গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। তাকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। এর পর একে একে অনেক রাঘববোয়াল ধরা পড়েন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর এখন পর্যন্ত যাদের গ্রেপ্তার করা হয় তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলেন যুবলীগ দক্ষিণের বহিস্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। অভিযানে একে একে গ্রেপ্তার হন ঠিকাদার জি কে শামীম, কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের এনামুল হক আরমান, অনলাইন ক্যাসিনো কারবারি সেলিম প্রধান, কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব, কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান রাজীব, ময়নুল হক মনজু, ক্যাসিনো কারবারি আক্তারুজ্জামান, রোকন মিয়া, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সাইফুল ইসলাম, তুহিন মুন্সী, নবীর হোসেন এবং পুরান ঢাকার স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা দুই ভাই এনু-রূপন, মহাপ্রতারক সাহেদ, ডা. সাবরিনা ও স্বাস্থ্যের গাড়িচালক আব্দুল মালেক।
একেকজন গ্রেপ্তারের পর তাদের জীবনের উত্থান পর্ব বেরিয়ে আসতে থাকে। ঠিকাদার জি কে শামীম এক সময় বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালেই তিনি সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ভোল পাল্টে যোগ দেন যুবলীগে। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদকের পদও বাগিয়ে নেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদও নিয়েছিলেন। যারা তাকে রাতারাতি পদ-পদবি পেতে সহায়তা করে বিত্তভৈববের সাম্রাজ্য অটুট রাখতে সহায়তা করেছেন, তারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। জি কে শামীমের মতো একইভাবে উত্থান ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিস্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার। এক সময় ফ্রিডম পার্টি করতেন চতুর খালেদ। এর পর যোগ দেন বিএনপির অঙ্গ সংগঠন যুবদলে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ঢাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল তার। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে যুবলীগের প্রতাপশালী নেতাও বনে যান তিনি।