নিজস্ব জেলা প্রতিবেদক : নোয়াখালীর সুবর্ণচরের পূর্ব চরবাটার বাসিন্দা নূর নবী মিলন। ২৫ বছর আগে চরনঙ্গলিয়ার বিস্তীর্ণ গোচারণভূমিতে তিনি শুরু করেন ৫০টি গরু-মহিষ পালন। সাত-আট বছরের মধ্যে এ চরে বসতি গড়ে ওঠায় অন্যান্য খামারির মতো তিনিও গরু-মহিষ নিয়ে কাছাকাছি নলেরচরে চলে যান। কিন্তু বসতির চাপে সেখানেও বেশিদিন টিকতে পারেননি। ২০১৪ সালে ১৫০টি গরু-মহিষ নিয়ে তিনি চলে যান দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার জাইজ্জারচরে। পরে ১৫০টি ভেড়া সেখানকার গোচারণভূমিতে ছেড়ে দেন।
মিলনের এসব পশু দেখাশোনা করতেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক। দুধ ও দই বিক্রি করে বেশ সুখেই কাটছিল তার সংসার। প্রতি মাসে ৭০-৮০ হাজার টাকার দুধ এবং প্রায় দেড় লাখ টাকার দই বিক্রি করতেন তিনি। মহিষের দই সরবরাহ করতেন ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। স্থানীয় বিভিন্ন বিয়ে ও অন্যান্য বড় অনুষ্ঠানেও কদর ছিল তার দইয়ের। কিন্তু কয়েক মাস ধরে তার রুটি-রুজি বন্ধ হয়ে গেছে। সংসারে ভীষণ টানাটানি চলছে তার।
এ দুরবস্থার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মিলন বলেন, একসময় দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বয়ারচর, চরনঙ্গলিয়া, নলেরচর ও কেয়ারিংচরে হাজার হাজার একরের বিশাল সব গোচারণভূমি ছিল। মেঘনার বুকে জেগে ওঠা সেসব চরে ধীরে ধীরে বসতি গড়ে ওঠে। জনবসতি ও নানা উন্নয়নে সেখানে এখন খালি জায়গা নেই। তবে মেঘনার বুকে নতুন জেগে ওঠা জাইজ্জারচর খামারিদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়।
মিলন জানান, চরের উর্বর মাটিতে ঘাসের অভাব নেই। শত শত রাখাল সেই চরে গরু-মহিষ ছেড়ে দেয়। কিন্তু হঠাৎ করেই এ চরের খাসজমির ওপর দৃষ্টি পড়ে প্রভাবশালীদের। তারা লাল পতাকা টানিয়ে মাটির বেড়িবাঁধ দিয়ে চরের প্রায় দুই হাজার একর জায়গা দখল করে নিয়েছে। চারপাশে লাগানো হচ্ছে ব্লেডজাতীয় কাঁটাতার। এই ভয়ানক কাঁটাতারের কারণে এরই মধ্যে আহত হয়েছে অনেক পশু। রাখালরাও এখন চরের মধ্যে যেতে পারছে না। চারদিকে বাঁধ দেওয়ার কারণে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে সব গরু, মহিষ ও ভেড়া। বর্ষা আসার পর ট্রাক্টর দিয়ে ধান চাষ শুরু হয়েছে। মিলনের দাবি, এ কারণে গত এপ্রিল থেকে ২২ জুনের মধ্যে শতাধিক ভেড়া ও অন্তত ১৫টি গরু মারা গেছে।
প্রভাবশালীরা এভাবে ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছেন সুবর্ণচর ও হাতিয়ার বিভিন্ন চরের গোচারণভূমি। ফলে অনিশ্চিত অবস্থার শিকার হচ্ছেন পশুখামারি ও রাখালরা; কমছে গরু, মহিষ ও ভেড়ার সংখ্যা। অবৈধভাবে দখলে নিয়ে প্রভাবশালীরা এসব চর ভূমিহীনদের দিয়ে তাদের কাছ থেকে অবৈধভাবে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। খামারিরা এ নিয়ে বারবার প্রশাসনের কাছে গেলেও মেলেনি সুফল; বরং প্রভাবশালীদের কোপানলে পড়েছেন তারা।
নোয়াখালীর হাতিয়ার বিচ্ছিন্ন এলাকা জাইজ্জারচর লক্ষাধিক গরু, মহিষ ও ভেড়ার বিচরণক্ষেত্র। এখান থেকে দৈনিক দুধ উৎপাদন হয় প্রায় ১০ হাজার লিটার। সম্প্রতি দলবল নিয়ে লাল পতাকা টানিয়ে এ চর দখলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রতন ব্যাপারির বিরুদ্ধে। পশু পালনে বাধা দিচ্ছেন তিনি।
সুবর্ণচরের পশ্চিম চরবাটার বাসিন্দা কামরুজ্জামান বাবুলের জাইজ্জারচরে তিনশ গরু-মহিষ আছে। তিনি বলেন, রতন ব্যাপারি তার লোকজন দিয়ে চর ও খাল দখল করে রেখেছেন। চরের গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। লাল পতাকা টানিয়ে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। চরে এখন খামারিরা যেতে পারছেন না। চরটি একেবারেই দখলে চলে গেলে আমাদের মরণ ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
নোয়াখালী সদর উপজেলার সোনাপুরের বাসিন্দা নূর নবীর এ চরে সাড়ে তিনশ গরু-মহিষ আছে। তিনি বলেন, প্রভাবশালীরা কাঁটাতার দিয়ে স্থায়ীভাবে চরে প্রবেশ বন্ধ করবে বলে শুনেছি। চরের চারপাশে এখন শত শত লাল পতাকা।
পশ্চিম চরবাটার জাফর উল্যাহ জানান, জাইজ্জারচরে বিচরণ করা তার ১৫০টি গরু-মহিষ নিয়ে তিনি বিপদে আছেন। চর থেকে গরু-মহিষ আনতেও যেতে পারছেন না।
একই এলাকার বাসিন্দা নুর নবী আজাদের ৮০০ ভেড়া ও ৩০০ গরু-মহিষ রয়েছে। তিনি বলেন, এখানে পশু পালন করার প্রধান সুবিধা হলো, গরুর জন্য বাড়তি কোনো খাবার কিনতে হয় না। চরের বুকে জেগে ওঠা কচি ঘাসগুলো খেয়ে এরা বড় হয়। শুধু শ্রমিক ও ওষুধ খরচ যায়।
চরটি চাষাবাদ করার জন্য সরকারের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নেওয়ার দাবি করেছেন অভিযুক্ত রতন ওরফে রতন ব্যাপারি। তবে বন্দোবস্ত-সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র তিনি দেখাতে পারেননি। রতন সমকালকে বলেন, এখানে শত শত একর খাসজমি পড়ে আছে। সাধারণ খামারিরাই আমাকে চাষাবাদের জন্য জমি দিয়েছেন। সেই জমি চাষ করে তাদেরও তিন ভাগের দুই ভাগ ফসল দেব।
গোচারণভূমি দখলের বিষয়ে গত এপ্রিল মাসে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক মো. খোরশেদ আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, কোনো রাখাল চরে গরু-মহিষ বিচরণ করাতে গেলে বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা জেনেছি, একজন বাধা দিচ্ছেন। এ বিষয়ে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।
কিন্তু প্রায় আড়াই মাসেও প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়নি। গত বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসক বলেন, তিনি হাতিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে আড়াই মাস আগে ঘটনাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেছিলেন। সেখানে এ রকম ঘটনা ঘটেনি বলে ইউএনও তাকে জানিয়েছেন।
এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সমকালের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসককে হোয়াটসঅ্যাপে গরু-মহিষের বর্তমান অবস্থা এবং চাষাবাদসহ গোচারণভূমি দখলের বেশকিছু ছবি ও ভিডিও পাঠানো হয়। ছবি ও ভিডিও পাওয়ার পর জেলা প্রশাসক বলেন, তিনি হাতিয়ার ইউএনওকে পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। জাইজ্জারচরের খাসজমি দ্রুত ভূমিহীনদের মধ্যে বন্দোবস্তের প্রক্রিয়া শুরু করব। বন্দোবস্ত দেওয়া পর ভূমিহীনরা সেখানে গোচারণভূমি কিংবা বাড়িঘর যা খুশি করবে।
এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার হাতিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমরান হোসেন বলেন, জেলা প্রশাসক গত বৃহস্পতিবারই প্রথম গোচারণভূমি দখলের বিষয়ে আমাকে জানিয়েছেন। এর আগে কিছুই জানতাম না। এ বিষয়ে নলেরচরের প্রশাসককে বলেছি, তার রিপোর্ট পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেব। গোচারণভূমি দখল হয়ে থাকলে উদ্ধার করবই।
নলেরচরের প্রশাসক আব্দুর রহিম বলেন, গোচারণভূমিটি দুর্গম এলাকায়। সেখানে যাতায়াতও কঠিন। তবে দু-একদিনের মধ্যে আমি সেখানে যাব।