নয়াবার্তা প্রতিবেদক : দেশে শহর এলাকার চেয়ে গ্রাম এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং বিদ্যুতের ঘনঘন আসা-যাওয়া বেশি ঘটছে। সঞ্চালন-বিতরণ লাইনে দুর্বলতা এবং নিম্নমানের ও ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্র ব্যবহারের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকা প্রতিদিনই কিছু সময় বিদ্যুত্হীন থাকছে। এই সমস্যার একটি বড় কারণ হিসেবে বিতরণ লাইনে নিম্নমানের অটোমেটিক সার্কিট রিক্লোজার (এসিআর) ব্যবহারকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) একজন তড়িৎ প্রকৌশলী কর্মকর্তা জানান, স্থিতিশীল বিদ্যুত্ সরবরাহের জন্য বিদ্যুত্ বিতরণ লাইনে অটোমেটিক সার্কিট রিক্লোজার (এসিআর) স্থাপন করতে হয়। বিদ্যুত্ লাইনে কোনো সমস্যা হলে এই যন্ত্র তা মুহূর্তেই টের পায়। এরপর বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় এবং চোখের পলকেই ফের বিদ্যুত্ সরবরাহ শুরু করে। গোটা কাজটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা হয় বলে যে এলাকায় এ যন্ত্রগুলো যত বেশি দক্ষতায় কাজ করে সে এলাকায় বিদ্যুত্ বিভ্রাট ও লোডশেডিং তত কম ঘটে।
গ্রাহক অভিজ্ঞতা অনুযায়ী দেশের মহানগর-শহর এলাকার চেয়ে মফস্বল-গ্রাম এলাকায় বিদ্যুতের বিভ্রাট বেশি। আর গ্রাম এলাকায় বিদ্যুত্ সরবরাহ করে মূলত বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। সারাদেশে চার কোটি ১৪ লাখ বিদ্যুত্ গ্রাহকের মধ্যে ৩ কোটি ১৪ লাখের বেশি গ্রাহক এ সংস্থাটির। এই আরইবির আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় নিম্নমানের ১১ কেভি অটোমেটিক সার্কিট রিক্লোজার (এসিআর) স্থাপন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ওয়ারেন্টি সীমার মধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে। ওয়ারেন্টি থাকলেও অনেক যন্ত্র প্রতিস্থাপন কিংবা মেরামতও করে দেয়নি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এর ফলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুত্ বিতরণে বিঘ্ন ঘটছে। বিদ্যুতের ঘনঘন আসা-যাওয়ার কারণে মানুষের ঘরের-দোকানের বিভিন্ন ইলেক্ট্রিক ও ইলেক্ট্রনিক পণ্য নষ্ট হচ্ছে। অথচ দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুত্ উত্পাদন সক্ষমতা রয়েছে।
আরইবি এলাকায় এই নিম্নমানের এসিআর ব্যবহার নিয়ে শঙ্কা জেগেছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অনেক কর্মকর্তার মনে। জানা যায়, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালে—এই তিন বছরে কেনা ৭৯৩টি ১১ কেভি এসিআরের সবগুলোই বর্তমানে ব্যবহার অনুপযোগী। এগুলো বিদ্যুত্ লাইনে ও সাবস্টেশনে স্থাপনের অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বিভিন্ন উপজেলায় বিদ্যুত্ বিভ্রাট বেড়ে যায়। এই যন্ত্রগুলোর প্রায় সবগুলোই নতুন যন্ত্র দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হলেও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে গ্রাহকদের। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে সরকারের। অপচয় হয়েছে জনগণের অর্থের।
সম্প্রতি আরইবি এলাকায় চারডন কোরিয়া কোম্পানির উত্পাদিত নিম্নমানের এসিআর কেনাকাটার অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করেছে বিদ্যুত্ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. নুরুল আলমের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি। ঐ কমিটি বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) অটোমেটিক সার্কিট রিক্লোজার যন্ত্র কেনাকাটায় গুরুতর অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে। পল্লী বিদ্যুত্ এলাকায় বিদ্যুতের ঘনঘন আসা-যাওয়ার একটি বড় কারণ এই নিম্নমানের এসিআর। অনিয়মের আশ্রয়ে কেনা এই যন্ত্রগুলো পরবর্তী সময়ে গ্রাহক ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর সম্প্রতি বিদ্যুত্ বিভাগের একটি তদন্ত দল রিপোর্টটি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দিয়েছে। রিপোর্টে বিশাল পরিমাণ সরকারি অর্থের ক্ষতি করায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করা হয়েছে।
১৮ মাস বেতন পাচ্ছেন না ৭৮৬ কারিগরি শিক্ষক১৮ মাস বেতন পাচ্ছেন না ৭৮৬ কারিগরি শিক্ষক
তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড চারডন কোরিয়া কোম্পানির উত্পাদিত ৭৯৩টি এসিআর ১২টি লটে কেনে প্রায় ৫০ কোটি টাকায়। এগুলো আরইবিকে সরবরাহ করে দেশ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি। সরবরাহকৃত এসিআরগুলোর মধ্যে ২৬৬টি যন্ত্রের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তথ্য পায়নি তদন্ত কমিটি। যে ৫২৭টি এসিআরের তথ্য পাওয়া গেছে তার মধ্যে ২৩০টি ওয়ারেন্টি সময়সীমার মধ্যে নষ্ট হয়েছে। নষ্ট হওয়া ২৫টি নতুন যন্ত্র দিয়ে প্রতিস্থাপন করে দেওয়া হলেও বাকি ২০৫টি প্রতিস্থাপন করে দেওয়া হয়নি। ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়নি। আরইবিও পারফরমেন্স গ্যারান্টির অর্থ হতে জরিমানার টাকা আদায় করেনি। এতে সরকারের ১২ কোটি ৮৬ লাখ টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানান, সুস্পষ্ট তথ্য-উপাত্ত চাওয়ার প্রায় ৯ মাস পর তা সরবরাহ করা হয়। এতে তদন্ত বিষয়ে আরইবির অনীহা রয়েছে বলে মনে করে কমিটি। তিনি বলেন, চারডন কোরিয়ার মতো অনভিজ্ঞ কোম্পানির কাছ থেকে এ কেনাকাটা সন্দেহজনক। ২০১৫ সালেই এ কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া অটোমেটিক সার্কিট ক্লোজারগুলো কেনা হয়। বিপুল ক্ষতির পর চারডন কোরিয়াকে কালো তালিকাভুক্ত করা হলেও যারা এটি সরবরাহ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আরইবি।
এ প্রসঙ্গে আরইবির সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, নির্দিষ্ট স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী এসিআর কেনা হয়। নিম্নমানের যন্ত্র কেনার প্রশ্নই উঠে না। তারপরও ওয়ারেন্টির মধ্যে সমস্যা হলে সেগুলো মেরামত করা হয় বা প্রতিস্থাপন করে দেওয়া হয়।