চিকিৎসকদের দেয়া ‘উপহারে’ অবৈধ কর রেয়াত নেয় স্কয়ার ফার্মা

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : দেশের প্রথম সারির ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। জাতীয় ঔষধ নীতিতে ওষুধের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ। কিন্তু ‘প্রমোশনাল আইটেম’ নাম দিয়ে চিকিৎসক, কেমিস্ট ও ড্রাগিস্টদের দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন উপহার, যার আড়ালে প্রচার করছে নিষিদ্ধ বিজ্ঞাপন। গিফটের তালিকায় প্যাড, কলম, মগ, টেবিল ল্যাম্প, ঘড়ি, লাইট, ভ্যানেটি ব্যাগ, বেল্ট, হেডফোন ও ছাতা থেকে শুরু করে জায়নামাজ সবই রয়েছে।

স্কয়ারসহ দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো নিষিদ্ধ বিজ্ঞাপন প্রচার করলেও নেয়া হয় না কোনো কার্যকর উদ্যোগ। এসব পণ্য কখনও আমদানি আবার কখনও স্থানীয় বাজার থেকে কিনে তাদের দেয়ার মাধ্যমে নিষিদ্ধ বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। শুধু বিজ্ঞাপন প্রচার নয়, এসব গিফটকে উপকরণ দেখিয়ে কোম্পানিগুলো নিচ্ছে অবৈধ কর রেয়াত। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) কয়েকটি ওষুুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রমোশনাল আইটেমের বিপরীতে অবৈধভাবে রেয়াত নেয়ার প্রমাণ পেয়েছে, যার মাধ্যমে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড অন্যতম।

এলটিইউ বলছে, অন্যান্য ওষুধ কোম্পানি শুধু প্রমোশনাল আইটেমে অবৈধ কর রেয়াত নেয়। কিন্তু দেশের প্রথম সারির ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকারী স্কয়ার ফার্মার অবৈধ রেয়াত নেয়ার ধরন দেখে হতবাক কর্মকর্তারা। প্রমোশনাল আইটেম বা গিফট ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিভদের দেয়া মোটরসাইকেলকেও উপকরণ দেখিয়ে নেয় অবৈধ রেয়াত। এছাড়া পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত গাড়ির চেসিস এবং ওয়্যারহাউসে উৎপাদিত পণ্য ও কাঁচামাল রাখার ইন্ডাস্ট্রিয়াল র‌্যাকেও উপকরণ দেখিয়ে নেয়া হয় অবৈধ রেয়াত। প্রতিষ্ঠানটি বছরের পর বছর উপকরণ সংজ্ঞার ভুল ব্যাখ্যা করে অবৈধ রেয়াত নিয়ে আসছে বলে এলটিইউয়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। অবৈধ রেয়াত নেয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত নোটিস জারি করা হয়েছে। তবে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস বিষয়টি নিয়ে এনবিআরের দ্বারস্থ হয়েছে। উপকরণের সংজ্ঞার স্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়ে সম্প্রতি এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে স্কয়ার ফার্মা। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এনবিআর-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় ঔষধ নীতি লঙ্ঘন করে ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রমোশনাল আইটেমের আড়ালে ওষুধের বিজ্ঞাপন প্রচার করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। প্রমোশনাল আইটেমের পণ্য যখন কোম্পানির বিজ্ঞাপন প্রচারে ব্যবহৃত হয়, তখন নেয়া অবৈধ। কোম্পানিরগুলোর বিরুদ্ধে মূসক আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

এনবিআর সূত্রমতে, প্রমোশনাল আইটেমের বিপরীতে ওষুধ কোম্পানিগুলো অবৈধ রেয়াত নিচ্ছে বলে অভিযোগ পায় এনবিআর। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে এলটিইউকে নির্দেশনা দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এলটিইউতে থাকা ওষুধ কোম্পানিগুলোর দাখিলপত্র ও আমদানি তথ্য যাচাই করে এলটিইউ। এতে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের বিরুদ্ধে অবৈধ রেয়াত গ্রহণের বিষয়ে তথ্য পায়। পরে সংশ্লিষ্ট সার্কেল থেকে প্রতিবেদন দেয়া হয়।

একটি প্রতিবেদনে স্কয়ার ফার্মার ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং অপর প্রতিবেদনে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আমদানি তথ্য ও দাখিলপত্র যাচাইয়ের তথ্য দেয়া হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী এলটিইউ কমিশনার স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর পৃথক দুটি নোটিস জারি করেন। দুটি নোটিসে প্রতিষ্ঠানকে শুনানিতে ডাকা হয় এবং অবৈধভাবে নেয়া রেয়াত কেন বাতিল হবে না, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি তথ্য ও দাখিলপত্র যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয়, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এলটিইউ, ঢাকার অধীন একটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানির তথ্য, দাখিলপত্র যাচাই ও পরীক্ষা করা হয়।

এতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি এই সময়ের ২১টি আইটেমের ওপর দুই কোটি ৮৪ লাখ সাত হাজার ৬১ টাকা অবৈধভাবে রেয়াত নিয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑপ্যাড, ট্রাক চেসিস, মোটরসাইকেল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল র‌্যাক, ঘড়ি, মার্কস, ডিসপ্লে কিবোর্ডসহ বিভিন্ন প্রমোশনাল আইটেম। প্রতিষ্ঠানটি আমদানি করা এসব পণ্যকে ‘প্রমোশনাল আইটেম’ হিসেবে উল্লেখ করে এবং উপকরণ দেখিয়ে এই রেয়াত নিয়েছে, যা মূসক আইন অনুযায়ী অবৈধ। এসব প্রমোশনাল আইটেম স্কয়ার ফার্মা বিভিন্ন চিকিৎসক, কেমিস্ট ও ড্রাগিস্টদের দিয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি এই সময়ে ১২টি আইটেমকে উপকরণ দেখিয়ে এক কোটি ৯৭ লাখ ২৪ হাজার ৯৬৯ টাকা রেয়াত নিয়েছে।

এনবিআর সূত্রমতে, স্কয়ার ফার্মা প্রমোশনাল আইটেমে রেয়াত পাবে বলে দাবি করে। তবে এলটিইউয়ের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারেনি। শেষে প্রমোশনাল আইটেম, চেসিস ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল র‌্যাকে রেয়াত নেয়ার বিষয়টি যৌক্তিক দাবি করে এবং বিষয়টি স্পষ্ট করতে ৯ নভেম্বর এনবিআরকে চিঠি দেয় স্কয়ার ফার্মা। এনবিআরকে দেয়া চিঠিতে ‘প্রমোশনাল আইটেম’ বিষয়ে স্কয়ার ফার্মার পক্ষ থেকে বলা হয়, মূসক আইনের উপকরণ সংজ্ঞার নেগেটিভ লিস্টে প্রমোশনাল আইটেমের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো কিছু উল্লেখ নেই। সে কারণে প্রমোশনাল আইটেমকে উপকরণ হিসেবে না দেখার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না। প্রমোশনাল আইটেমগুলো আমরা সেবা হিসেবে ক্রয় করে থাকি। সেজন্য প্রমোশনাল আইটেমের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার জন্য এনবিআরের দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। এনবিআর ব্যাখ্যা দিলে উপকরণ বিষয়ে ভুল বুঝাবুঝির অবসান গড়বে।

পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত গাড়ির চেসিস, উৎপাদিত পণ্য ও কাঁচামাল ওয়্যারহাউসে রাখার জন্য ব্যবহƒত ইন্ডাস্ট্রিয়াল র‌্যাকের উপকরণ কর রেয়াতের বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়, এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের উৎপাদিত ওষুধকে সকল ক্ষেত্রে জিএমপি অনুসরণ করতে হয়। সে অনুযায়ী আমরা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরবরাহ ও রপ্তানি করে থাকি। সে কারণে আমাদের উৎপাদিত পণ্য ও কাঁচামাল সুরক্ষার জন্য আমাদের কারখানার অভ্যন্তরে ওয়্যারহাউজে সেলফের ক্ষেত্রে ইন্ডাস্ট্রিয়াল র‌্যাক ব্যবহার করতে হয়। এ-জাতীয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল র‌্যাক কোনো অবকাঠামো বা ইমারতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। এছাড়া পণ্য পরিবহনে আমরা স্থানীয় পর্যায় থেকে গাড়ির চেসিস ক্রয় করে পরবর্তী পর্যায়ে বডি তৈরি করে সেই পরিবহনে কারখানা থেকে উৎপাদিত পণ্য আমাদের নিজস্ব ডিপোতে সরবরাহ করে থাকি। মূসক আইন অনুযায়ী এই পরিবহন যাত্রী যানবাহন নয় এবং এই পরিবহন আমাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। ফলে এটি উপকরণ হিসেবে কর রেয়াত গ্রহণ না করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এনবিআরের একটি সূত্র শেয়ার বিজ জানিয়েছে, স্কয়ার ফার্মার চিঠির পর এই নিয়ে এনবিআর কাজ করছে। সহসাই প্রমোশনাল আইটেম, ইন্ডাস্ট্রিয়াল র‌্যাক ও গাড়ির চেসিসে উপকরণ কর রেয়াত পাবে কি না, তা স্কয়ার ফার্মা ও এলটিইউকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়া হবে। তবে কোনোভাবেই রেয়াত পাবে না বলে সূত্র জানিয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরীর ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন দেয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের পরিচালক (অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করি। ভোক্তা থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করে দেয়। সরকারের সহযোগিতা না থাকলে তো ওষুধ ইন্ডাস্ট্রির এত বিকাশ হতো না।’ উপকরণ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল আইটেম নিয়ে এলটিইউ’র প্রতিবেদন বিষয়ে তিনি বলেন, ‘উপকরণ নাকি উপকরণ নয় এই নিয়ে আমাদের আলোচনা চলছে। এই নিয়ে আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের গ্যাপ আছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা এরই মধ্যে কয়েকটি সভা করেছি। আমরা একটা উইন উইন সিচুয়েশনে এসেছি। বিষয়টি এখনও সাব-জুডিশিয়াল। তাই এখনও কনক্লুশন বা মতামত দেয়ার সময় আসেনি।’

এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জাতীয় ওষুধ নীতি, ২০১৬’-এর অনুচ্ছেদ ৪.৯ (বি)-তে বলা হয়েছে, ‘লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন ছাড়া ঔষধের কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না এবং অনুমোদনহীন বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই লক্ষ্যে যে কোনো অনৈতিক বিপণন কিংবা বহুস্তর বিপণন রোধ করা হবে।’ অর্থাৎ আইনের এই অংশের বিধান অনুযায়ী ওষুধ কোম্পানির ‘প্রমোশনাল আইটেম’ অবৈধ। বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করব।

Share