পিছমোড়া শফিকুল ও মুক্ত সাংবাদিকতা

সোহরাব হাসান : পুলিশ পিছমোড়া করে হাতকড়া পরিয়ে একজন আসামিকে নিয়ে যাচ্ছে আদালতে। এই আসামি আর কেউ নন, ৫৪ দিন ধরে নিখোঁজ থাকা সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম ওরফে কাজল। তিনি ডাকাত বা সন্ত্রাসী নন। একজন সুপরিচিত আলোকচিত্রী ও একটি নিউজপোর্টালের সম্পাদক। এর আগে কাজ করেছেন নিউ এজ, বণিক বার্তা ও দৃক নিউজে।

পুলিশ সাধারণত আসামিকে তখন হাতকড়া পরায়, যখন তাঁর পালিয়ে যাওয়া কিংবা পুলিশের ওপর চড়াও হওয়ার ভয় থাকে। এখানে এসবের কিছুই ছিল না। তারপরও পুলিশ তাঁকে এভাবেই যশোরের একটি আদালতে হাজির করে। আর ঘটনাটি ঘটে ৩ মে, যেদিন আমরা বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস পালন করেছি। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ভয় ও পক্ষপাতমুক্ত সাংবাদিকতা।’ বাস্তবে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় ভয় ও পক্ষপাত দুটোই ভালোভাবে জেঁকে বসেছে।

যশোর ৪৯ বিজিবির রঘুনাথপুর ক্যাম্প কমান্ডার হাবিলদার আশেক আলীর দাবি, শফিকুল শনিবার রাতে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারত থেকে দেশে ফিরছিলেন। রাত পৌনে তিনটার দিকে তিনি বেনাপোল আন্তর্জাতিক শূন্যরেখায় এলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত ১০ মার্চ ঢাকার হাতিরপুলে নিজের অফিস থেকে বের হয়ে সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম নিখোঁজ হন। ১৮ মার্চ পরিবারের পক্ষ থেকে চকবাজার থানায় একটি মামলাও করা হয়। একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, তিনি যেখান থেকে নিখোঁজ হন, সেখানে কয়েকজন তরুণ তাঁর মোটরসাইকেল ফলো করছিলেন। সেই ভিডিওর সূত্র ধরে কাউকে ধরার বা রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা হয়েছে বলে মনে হয় না। এখন বলা হচ্ছে ভারত থেকে এসে শফিকুল নিজেই সীমান্তরক্ষীদের কাছে ধরা দিয়েছেন। এটি কি বিশ্বাসযোগ্য?

শফিকুলের ছেলে মনোরম পলক জানান, শনিবার দিবাগত রাত পৌনে তিনটায় বেনাপোল থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মায়ের টেলিফোন নম্বরে ফোন করে শফিকুলকে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওনার সঙ্গে কথা বলেন।’ শফিকুল ফোনে বলেন, ‘আমি বেনাপোল থানায় আছি। আমাকে এসে নিয়ে যাও।’ পলক জানান, ভোর ছটায় তিনি ঢাকা থেকে বেনাপোলের উদ্দেশে রওনা হন।

পরের ঘটনা দেশের মানুষ টিভি ও পত্রিকার মাধ্যমে দেখেছে। হাতকড়া পরিয়ে শফিকুলকে আদালতে নেওয়ার পর যশোরের জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে আনা দুটি মামলার শুনানি হয়। একটি মামলার অভিযোগ, তিনি কাগজপত্র ছাড়া দেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। শফিকুল বাংলাদেশের নাগরিক। তিনি নিজের দেশে অনুপ্রবেশ করবেন কেন? এই মামলায় বিচারক তাঁকে জামিন দিয়েছেন। কিন্তু মুক্তি মেলেনি। আরেক মামলায় তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই মামলাটিও রহস্যজনক। পুলিশ যখন নিশ্চিত হলো যে এই শফিকুলের বিরুদ্ধেই ঢাকায় একাধিক মামলা আছে, তারা ৫৪ ধারায় নতুন করে কেন মামলা করল? তাঁর নামে যে থানায় মামলা হয়েছিল, সেই থানায় সোপর্দ করাই নিয়ম।

শফিকুল নিখোঁজ হওয়ার কয়েক দিন আগে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন নরসিংদীর আটক যুবলীগ নেত্রী পাপিয়াকে নিয়ে। পাপিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা ও সাংসদের কী সম্পর্ক ছিল সেসব নিয়ে। সেই সূত্র ধরে সাংসদ সাইফুজ্জামান শিখর তাঁকেসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন শেরেবাংলা নগর থানায়।

সাংবাদিকদের ঘায়েল করার মোক্ষম অস্ত্র এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনের অপব্যবহারের দৃষ্টান্ত অসংখ্য। দেশের সাংবাদিক মহলসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এই আইন একটি কালো আইন হিসেবে বিবেচিত। নেতা-নেত্রীদের নামে কোনো স্ট্যাটাস দিলে মামলা। ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট হলে মামলা। প্রকাশিত কোনো খবর ফেসবুকে আপলোড করলেও মামলা। আর ডিজিটাল আইনের এমনই কারিশমা যে মামলা করলে তদন্তের অপেক্ষা করতে হয় না। গ্রেপ্তার করে সোজা জেলখানায় পাঠিয়ে দেওয়া। কিন্তু সাংবাদিকদের ওপর হামলায় মামলা হওয়ার ঘটনায় যদি কোনো মামলা হয়, সেটি আর এগোয় না।

বাংলাদেশে নিখোঁজ বা গুমের ঘটনা বহু বছর ধরেই চলে আসছে। বেশির ভাগেরই হদিস মেলে না। কেউ কেউ ফিরে আসেন। কিন্তু তাঁরা কোথায় ছিলেন, কে বা কারা তাঁদের নিয়ে গিয়েছিল, সেই রহস্যের কোনো কূলকিনারা হয় না। শফিকুলে ঘটনায় যেসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরি, তা হলো তিনি কি ভারতে স্বেচ্ছায় বৈধ কাগজপত্র ছাড়া চলে গিয়েছিলেন? নাকি তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল?

গণমাধ্যম নিয়ে সরকারের নীতি দ্বিমুখী ও প্রতারণামূলক। একদিকে নেতা-মন্ত্রীরা গুজব ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশন করতে বলেন। অন্যদিকে কোনো গণমাধ্যম সরকারের কোনো দপ্তর বা বিভাগের দুর্নীতি, অনিয়ম ও অযোগ্যতার চিত্র তুলে ধরলে তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সংবাদ সম্মেলনেও সেসব গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার থাকে না। সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা কায়দায় বাধা সৃষ্টি করে গণমাধ্যমকে শাস্তি দেওয়ার যে চণ্ডনীতি সরকার বিভিন্ন সময়ে নিয়েছে, তার শিকার প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ আরও কোনো কোনো পত্রিকা।

করোনা সংকট উত্তরণে যখন গণমাধ্যমকর্মীরা সঠিক তথ্যটি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন, তখন ক্ষমতাসীন মহল থেকে বলা হলো সংবাদ সম্মেলনে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। সরকার যখন দাবি করছে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা আছে, তখন বাস্তব অবস্থাটা কী? সম্প্রতি রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮০টি দেশের মধ্য বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১টি। আর দক্ষিণ এশিয়ার সবার নিচে। এসব তথ্য ক্ষমতাসীনদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে আমরা ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছি।

শফিকুলই সাংবাদিক হয়রানির প্রথম ও শেষ উদাহরণ নয়। কিছুদিন আগে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসনের নামে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার কারণে এক সাংবাদিককে মিথ্যা মামলা দিয়ে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল। ত্রাণের অনিয়ম–দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার কারণে অনেক সাংবাদিকের ওপর হামলা চালানো হয়েছে।

সম্প্রতি দিনাজপুরে ত্রাণের অনিয়মের দুর্নীতি নিয়ে খবর প্রকাশ করায় বিডিনিউজ ২৪. কম ও জাগো নিউজের সম্পাদকের নামে ডিজিটাল আইনে মামলা করেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতা। একই কারণে সাভার ও বগুড়ায় তিন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে একটি ঘটনায় ডেইলি স্টার সম্পাদকের বিরুদ্ধে ৭০–৮০টি মামলা হয়েছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে। প্রথম আলোর সম্পাদকের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে দেশজুড়ে অন্তত ৫০টি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে ৫১ জন সংবাদকর্মী হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেকের নামে মামলা হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছেন। এমন ভয়ের পরিস্থিতিতে মুক্ত সাংবাদিকতা কী করে সম্ভব?

প্রথম আলোর সৌজন্যে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি।

Share