আবারও সংঘাতে জড়ালো ফিলিস্তিন–ইসরায়েল। বরাবরের মতো সামনে চলে এসেছে নিজভূমি হারানো ফিলিস্তিনের ট্র্যাজিডি। কীভাবে ইসরায়েল সৃষ্টি হলো, সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে কী প্রভাব পড়ল, ইহুদি গণহত্যার দায় ইউরোপ কীভাবে ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপিয়ে দিল—গোটা পরিস্থিতিকে সংক্ষিপ্তভাবে পর্যালোচনামূলক ইতিহাস আকারে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে এ লেখাতে।
গত এপ্রিলে ঘটা করে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ৭০ তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করেছে ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা। এটি তারা করেছে হিব্রু বা ইহুদি বর্ষপঞ্জির হিসাবে, যদিও প্রচলিত গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে জবরদখলের ভিত্তিতে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয় ১৯৪৮ সালের ১৪ মে।
এর মধ্য দিয়ে যুগের পর যুগ বংশপরম্পরায় এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী অন্তত সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি আরবের জীবনে এক অশেষ বিপর্যয় নেমে আসে। ১৫ মে ফিলিস্তিনিরা পালন করে আল-নাকবা (বিপর্যয়) দিবস হিসেবে। সোজা কথায়, ইসরায়েলের স্বাধীনতার ৭০ বছর মানে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতি ঘটা, উদ্বাস্তু হওয়া ও নিজ ভূমে পরবাসের ৭০ বছর।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে অর্ধসত্য ও জবরদস্তির ভিত্তিতে। ধর্মভিত্তিক উপাখ্যান ও পুরাকথাকে (মিথোলজি) ইতিহাসের সঙ্গে মিশিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় তৈরি করা হয়েছে ইসরায়েল রাষ্ট্র, যা নাকি ইহুদিদের জন্য ঈশ্বরের ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ (প্রমিজড ল্যান্ড)।
তাদের দাবি, তারা হলো তানাখ বা হিব্রু বাইবেল অথবা ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত সেই জাতিগোষ্ঠীর সরাসরি উত্তরাধিকার, যারা মিসর থেকে সিনাই উপত্যকা হয়ে কেনানে ফিরে এসেছিল এবং তারাই ঈশ্বরের ‘মনোনীত সম্প্রদায়’ (চৌজেন পিপল)। মহাপ্রভু তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে দুধ ও মধুর এই দেশে তারা শান্তিতে বসবাস করবে। এখানেই গড়ে উঠেছিল ডেভিড ও সোলেমানের [কোরআন অনুসারে হজরত দাউদ (আ.) ও হজরত সোলায়মান (আ.) ]
সমৃদ্ধিশালী রাজ্য, যা কালক্রমে ইসরায়েল ও জুদাহ নামে দুই ভাগ হয়। পরবর্তী কালে দুই দফা (একবার খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে, আরেকবার ৭০ খ্রিষ্টাব্দে) কথিত এই হিব্রু জনগোষ্ঠীর মানুষেরা নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয় দফা নির্বাসনের পর থেকে ইহুদিরা মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তারা সব সময়ই জানত যে ঈশ্বর-প্রতিশ্রুত ভূমিতে একদিন তারা বা তাদের উত্তরসূরিরা ফিরে আসবে।
অবশেষে ঊনবিংশ শতকে এসে ইহুদিদের প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি হতে থাকে। এই সময়েই হিব্রু বাইবেলের নানা উপাখ্যানকে ভিত্তি করে ইহুদি জাতির ইতিহাস রচিত হতে থাকে। ১৮৯৭ সালে হাঙ্গেরীয় সাংবাদিক, আইনজীবী ও নাট্যকার থিওডোর হারজেল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন বৈশ্বিক জায়নবাদী সংস্থা (ওয়ার্ল্ড জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন)। প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরে যাওয়া তথা ইহুদিদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি গঠন ও তার বিকাশ সাধনই হয় এই উগ্র জায়নবাদের লক্ষ্য, যা কিনা অল্প সময়ের মধ্যে ইউরোপের খ্রিষ্টানদের একাংশের সমর্থন লাভ করে। এই খ্রিষ্টানদের বলা হয় জায়নবাদী খ্রিষ্টান।
জায়নবাদীরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’র ঐশ্বরিক ও ঐতিহাসিক গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এই প্রবণতা আজও অব্যাহত আছে।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার বেলফোর ১৯১৭ সালে জায়নবাদীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে বসেন, যা বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত।
১৯১৮ সালে ফিলিস্তিন দখল করে ১৯২০ সালে ব্রিটিশ রাজ ম্যানডেটরি প্যালেস্টাইনের শাসনভার গ্রহণ করে, প্রথম মহাযুদ্ধ পর্যন্ত যা ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। এরই মধ্যে দলে দলে ইহুদিরা ইউরোপ থেকে পাড়ি জমাতে শুরু করে সেখানে। ব্রিটিশদের মদদেই অভিবাসী ইহুদিদের নিয়ে ১৯২১ সালে গঠিত হয় হাগানাহ নামের একটি আধা সামরিক বাহিনী। পরবর্তী সময়ে আরও দুটি জায়নবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইরগুন ও স্টার্ন গ্যাং গড়ে ওঠে। এরা ইউরোপ থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হলোকাস্টে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদিকে নিধন করা হয় মূলত হিটলারের পরিকল্পনায়। এই হলোকাস্ট ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিকে জোরদার করে তোলে। ইউরোপ হলোকাস্টের অপরাধ করলেও শাস্তি চাপানো হয় আরবদের ওপর।
দ্বিধাবিভক্ত ও দুর্বল আরব নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব ছিল না যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ ও সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট ইহুদিদের প্রতিরোধ করা। ফলে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হয়। সীমানা নির্ধারিত হয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবানুসারে। লাখ লাখ ফিলিস্তিনির ওপর নেমে আসে নাকবা বা বিপর্যয়। এরপর ৭০ বছর ধরে চলছে সেই বিপর্যয়।
১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর সদ্য গঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অন্যায়ভাবে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ইহুদি ও আরবদের মধ্যে দুই ভাগ করার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। বেন গুরিয়নের নেতৃত্বে জায়নবাদীরা স্বদেশের মাটি থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করার জন্য তৈরি করে প্ল্যান ‘দালেত’।
দ্বিধাবিভক্ত ও দুর্বল আরব নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব ছিল না যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ ও সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট ইহুদিদের প্রতিরোধ করা। ফলে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হয়। সীমানা নির্ধারিত হয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবানুসারে। লাখ লাখ ফিলিস্তিনির ওপর নেমে আসে নাকবা বা বিপর্যয়। এরপর ৭০ বছর ধরে চলছে সেই বিপর্যয়।
হিব্রু বাইবেলভিত্তিক নানা উপাখ্যানকেই সত্য ইতিহাস হিসেবে দাঁড় করানো ছাড়া জায়নবাদীদের পক্ষে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের নৈতিক সমর্থন ও বিশ্ব স্বীকৃতি পাওয়া খুব কঠিন ছিল। তাই এই মিথোইতিহাস বিনির্মাণ ও লালনের কাজটি আজও তারা করে যাচ্ছে। এ জন্য নৃতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্ব থেকে জেনেটিক প্রযুক্তি-সবই ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছে। মুশকিল হলো, এগুলো করতে গিয়েই বারবার ধরা পড়ছে যে জায়নবাদীদের প্রচারিত হিব্রু জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস বহুলাংশে কল্পিত, বিকৃত ও মিথ্যা।
খোদ ইহুদি ইতিহাসবিদ, গবেষক, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই তা বলছেন। তাঁদের কেউ কেউ এ-ও বলছেন যে ফিলিস্তিনিরাই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এই ভূখণ্ডে বসবাস করে আসছে এবং তারাই সেই প্রাচীন জুদাহ ভূমির সন্তান।
ফিলিস্তিনিরাও প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই অবরুদ্ধ ভূমিতে অসম দানবিক শক্তির সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করে এখনো টিকে আছে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে।
এ প্রসঙ্গে ইসরায়েলের ৭০ তম বার্ষিকী উপলক্ষে দেশটির সবচেয়ে পুরোনো ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক পত্রিকা হারেৎস যে সম্পাদকীয় (১৮ এপ্রিল, ২০১৮) লিখেছে, ‘৫০ বছর ধরে সামরিক শক্তি দিয়ে ইসরায়েল লাখ লাখ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের অধিকারহীন করে। এটা তাদের ভূমি কেড়ে নিয়েছে, ভূমির মালিকদের বাস্তুচ্যুত করেছে আর সেখানে গড়েছে বসতির পর বসতি, যেখানে হাজার হাজার ইসরায়েলি বসবাস করছে।…৭০ তম বার্ষিকীর উদ্যাপন দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু দখলদারির অভিশাপ ঘোচানোর কোনো আভাসই নেই।…৭০ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করার অধিকার ইসরায়েলের আছে। এতগুলো বছরে অর্জিত অসংখ্য সাফল্য নিয়েও সে গর্বিত হওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু সত্যিকারের স্বাধীনতা সে তখনই উদযাপন করতে পারবে, যখন তার প্রতিবেশী ফিলিস্তিন রাষ্ট্রও নিজের স্বাধীনতা উদযাপন করতে পারবে।’