বাংলাদেশ ব্যাংকে দ্রুত কমছে সরকারের ঋণ

নয়াবার্ত‍া প্রতিবেদক : উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার সরবরাহ কমাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ঋণ দ্রুত কমিয়ে বাড়ানো হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংকে সরকারের ঋণ ৩১ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা বেড়েছে। একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কমেছে ২৭ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের ঋণ বেড়েছে মাত্র ৩ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমেছে।

গত অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংক আমানতে প্রবৃদ্ধি রয়েছে ১০ শতাংশের কম। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ২ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছর কমেছিল ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। আবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করায় বাজার থেকে উঠে এসেছে ৬৫ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া বন্ধ রেখেছে সরকার। যে কারণে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার দ্রুত বাড়ছে। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে রেপো ও বিশেষ রোপোর মাধ্যমে প্রতিদিন প্রচুর ধার দিচ্ছে। বর্তমানে এ ধারের স্থিতি রয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। না হলে সংকট আরও বাড়ত।

বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি সরকারকে ঋণ দেওয়া বন্ধ রাখায় ট্রেজারি বিলের সুদহার দ্রুত বাড়ছে। গত সোমবার ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সর্বোচ্চ সুদ উঠেছে ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত মাসে যা ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ ছিল। গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির পর এটাই সর্বোচ্চ। ওই মাসে ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সর্বোচ্চ সুদ উঠেছিল ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ।

৯১, ১৮২ ও ৩৭৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিল বিক্রি করে টাকা নেয় সরকার। আর ট্রেজারি বন্ডের মেয়াদ ২, ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর। অন্য সব ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহারও অনেক বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার রেকর্ড ১ লাখ ২২ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নেয়। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি সরবরাহ করে রেকর্ড ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত জুন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ঋণ স্থিতি দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। এখন নতুন করে ঋণ না নিয়ে কমানোর ফলে গত নভেম্বর শেষে এটি কমে ১ লাখ ৩০ হাজার ৫ কোটি টাকায় নেমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি ঋণ দেওয়ার মানে নতুন টাকা ছাপানোর মতো। এ প্রবণতা মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেয়। যে কারণে এভাবে ঋণ সরবরাহ না করার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও ঋণ কমানোর পরামর্শ উঠে আসে। তবে আশানুরূপ রাজস্ব আদায় না হওয়া, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমাসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাংক থেকেই ঋণ নিচ্ছিল সরকার।
চলতি অর্থবছর ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিট ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে করা হয় ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। যদিও শেষ পর্যন্ত সরকার নেয় ১ লাখ ২২ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। টানা বেশ কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশে রয়েছে। যে কারণে মূল্যস্ফীতি কমাতে ঋণ সরবরাহ কমাচ্ছে সরকার।

নানা সমালোচনার পরও ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ ছিল। তবে আইএমএফের শর্ত এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য চলতি বছরের জুলাই থেকে সুদহারের নতুন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। বর্তমানে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদহারের সঙ্গে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ করে সর্বোচ্চ সুদ নির্ধারণ করা হচ্ছে। এ ব্যবস্থাকে বলা হচ্ছে সিক্সমান্থ মুভিং অ্যাভারেজ রেট ওয়ান ট্রেজারি বিল বা স্মার্ট। ট্রেজারি বিলের সুদহার বাড়ার কারণে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদও দ্রুত বাড়ছে। গত নভেম্বরের স্মার্ট ছিল ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। এর মানে ডিসেম্বরে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

Share