নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : এন্ড্রু কিশোর, আমাদের ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ এবং আমার যিনি বড় ভাই, বন্ধু, সুহৃদ এবং দীর্ঘ সংগীত জীবনের সহপথিক- তিনি আজ নেই। এই একটা লাইন লিখতে কত কষ্ট হয়েছে, তা বলে বোঝানো যাবে না। এ শুধু এক কাছের মানুষ ও প্রিয় শিল্পীকে হারানোর দুঃসংবাদ নয়, বুকের পাঁজর থেকে তুলে আনা এক কষ্টের ধ্বনি। বারবার কানে বাজে তার শেষ কথাগুলো, ‘একটু আশীর্বাদ করো, যেন শান্তিতে মরতে পারি।’ এই একটি কথায় অনুমান করা যায়, কর্কট রোগের অসহনীয় যন্ত্রণায় বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুকেই শান্তির বলে মনে হয়েছিল তার।
ক’দিন আগের কথা, এন্ড্রু দা সিঙ্গাপুর থেকে ফিরলেন, গেলেন রাজশাহীতে। তার খোঁজ-খবর নিচ্ছি, এটা জেনে অসুস্থতার মধ্যেও আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। চিকিৎসক আর পরিবারের সদস্যদের বিধিনিষেধের পরও টানা ৪০ মিনিট কথা বলেছিলেন। সে শুধু কথা নয়, যেন দৃশ্যের পর দৃশ্য চোখের সামনে তুলে ধরছিলেন। আমিও মনের পর্দায় দেখছিলাম, হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলোর দৃশ্যপট। মগবাজার ছিল আমাদের কয়েক শিল্পী ও মিউজিশিয়ান বন্ধু ও ভাইয়ের ঘাঁটি। এন্ড্রু দা, লিটন অধিকারী রিন্টু, বাচ্চুসহ আরও অনেকে ছিলেন। যাদের সঙ্গে প্রতিদিন ঘরে-বাইরে, স্টুডিওতে চলত আড্ডা। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে একেকদিন একেকজনের বাসায় যাওয়া, থাকা-খাওয়া, গানের আসর বাসানো- সবই চলত। এন্ড্রু দার বিয়ের গাড়ি সাজানো, ফার্নিচার কেনা থেকে শুরু করে প্রথম টেলিভিশন, ভিসিআর কেনা, চট্টগ্রাম থেকে গাড়ি এনে দেওয়ার মতো ঘরোয়া কাজগুলোও করেছি। এতটাই আপন মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি, তার প্রতিটি কাজ করেছি আপনজন এবং একই পরিবারের সদস্য মনে করে। এন্ড্রু দাও এটাই ভাবতেন। মায়ের চলে যাওয়ায় তাই ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। ভয়ানক অসুস্থতার মধ্যেও চেয়েছিলেন মায়ের শেষকৃত্যে অংশ নিতে। এই যে একেকটি ঘটনা, আনন্দ-বেদনার স্মৃতি, তা কখনও ভুলে থাকা যাবে না। তার সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই আজ স্মৃতির ফ্রেমে ছবির মতো বন্দি হয়ে আছে। সে স্মৃতির বহর এতই দীর্ঘ যে, আজীবন বয়ে বেড়ালেও তার সমাপ্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
একজন এন্ড্রু কিশোর কীভাবে সংগীতের মহিরুহ হয়ে উঠেছিলেন, তা কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। যদিও তার রাজশাহী অধ্যায়ের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই, কিন্তু সেই ইতিহাস অন্য সবার মতো আমারও অজানা নয়। অনেকের মুখেই শুনেছি, তরুণ বয়সেই এন্ড্রু কিশোর হয়ে উঠেছিলেন রাজশাহীর তারকাশিল্পী। রাজশাহীর সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়ের ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চুর এই শিষ্য, নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, পল্লীগীতি ও দেশাত্মবোধক গানের সবক’টি শাখায় পুরস্কৃৃত হয়েছিলেন। তখনই হয়েছিলেন রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী। সেখানে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে, বিভিন্ন আয়োজনে এন্ড্রু কিশোরকে থাকতেই হতো। তার গায়কি নিয়েও তখন থেকে গর্ব করা শুরু করেছিলেন রাজশাহীর বাসিন্দারা। এরপর সত্তর দশকের মাঝামাঝি ঢাকায় আসেন তিনি। শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়। ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ ছবিতে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী’ শিরোনামের একটি গানের মাধ্যমে তার প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং প্লেব্যাক সম্রাট হয়ে ওঠার বীজ রোপিত হয়। সেই শুরু, এরপর আর থেমে থাকা নেই। সিনেমার গানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন তিনি। টানা চার দশকে কত হাজার গান গেয়েছেন, সেই হিসাব বের করাও কঠিন। প্লেব্যাকের বাইরেও একক, দ্বৈত, মিশ্রসহ কয়কশ’ অ্যালবামে গান করেছেন। কণ্ঠ দিয়েছেন টিভি নাটকের গানে এবং জিঙ্গেলে [বিজ্ঞাপনের গান]। কয়েক দশক ধরে একের পর এক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন তিনি। অনবদ্য গায়কি আর সংগীত সাধনার স্বীকৃতি হিসেবে সর্বাধিক আটবার [পুরুষ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে] পেয়েছেন সেরা শিল্পীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এর বাইরেও অগণিত পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। অবশ্য এ তথ্য কম-বেশি সবারই জানা, যা নতুন করে এ লেখায় তুলে না ধরলেও চলে। এন্ড্রু কিশোরকে কেন বর্ণাঢ্য শিল্পীজীবনের পথিকৃৎ বলা হয়, সেটা জানাতেই মূলত এই প্রসঙ্গ তুলে আনা।
এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮২ সালে। তখন থেকেই বড় ভাইয়ের স্নেহ পেয়েছি তার কাছে। একসঙ্গে বহু ছবিতে গান করেছি আমরা। একসঙ্গে কাজ করা আর কাছাকাছি থাকার সুবাদে তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি, তিনি কতটা গোছানো, বন্ধুবৎসল, সদালাপী মানুষ। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এত বড়মাপের শিল্পী হওয়ার পরও তার মধ্যে কখনও অহম ভর করেনি। ছিলেন নিভৃতচারী এবং যাবতীয় আত্মপ্রচার থেকে নিজেকে সবসময় সরিয়ে রেখেছিলেন। এমন নিরহঙ্কার শিল্পী খুঁজে পাওয়া ছিল সত্যি কঠিন।
একটা ঘটনার কথা আজ খুব মনে পড়ছে। নাদিম-শাবানা জুটির ‘শক্তি’ ছবির বাংলা ভার্সনের কাজ চলছে। ছবির বাংলা গানগুলোর সংগীত পরিচালনা করবেন আলাউদ্দিন আলী। তিনি আমাকে আর এন্ড্রু দাকে একটি উর্দু গানের বাংলা ভার্সন গাওয়াবেন। তাই আমাদের দু’জনকে বললেন, ‘তোরা এই গানটা তুইলা আন, এরপর রেকর্ড করুম। কিন্তু গান রেকর্ড করতে গিয়ে আলাউদ্দিন ভাই রেগে অস্থির। বলছেন, নোটের এক জায়গায় ভুল হচ্ছে। তোরা কি গান তুলে আনোস নাই? কী বলব, আসলেই আমাদের গানটা ঠিকভাবে তোলা হয়নি। এমন সময় এন্ড্রু দা বললেন, ‘বিশ্ব, সরি, আমি গানটা ঠিকমতো তুলি নাই। এজন্যই গানের নোটে বারবার ভুল হচ্ছে।’ সিনিয়র শিল্পী হয়েও আমার কাছে এন্ড্রু দা ভুল স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেননি, এখানেই তার মাহাত্ম্য।
আশির দশকে এন্ড্রু দা আর আমার মধ্যে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। দেখা গেছে, আলাউদ্দিন আলী যেসব ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছেন, তার বেশিরভাগ গানের প্লেব্যাক শিল্পী আমি। অন্যদিকে আলম খানের সংগীত পরিচালনায় এন্ড্রু দা নিয়মিত গাইছেন। তখন এই দুই সংগীত পরিচালকের কাজ নিয়ে যতটা আলোচনা, ততটাই আমাদের নিয়ে। আবার এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও একসঙ্গে বহু গান গেয়েছি আমরা। আমাদের গানগুলো দুই বন্ধু, দুই ভাইয়ের চরিত্রগুলোর কণ্ঠে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে ভালো কিছু করে দেখানোর জন্য যতই প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠি না কেন, দিন শেষে আমাদের সম্পর্কটা থাকে ভাই-বন্ধু। একসঙ্গে আড্ডা, গান-বাজনা নিয়ে আলোচনায় অনেকটা সময় পার করতাম আমরা। এই আড্ডার সূত্র ধরেই টিভি অনুষ্ঠানে আমাদের একসঙ্গে গান গাওয়া। যদিও আশি-নব্বই দশকে অসংখ্য ছবিতে আমরা গান করেছি। কিন্তু টিভি অনুষ্ঠানে আমাদের একসঙ্গে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেক পরে। হানিফ সংকেতের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ‘ইত্যাদি’-এর একাধিক পর্বে একসঙ্গে গান করেছি। ভালো লাগার আরেকটি বিষয় হলো, এন্ড্রু দা শুধু আমার সঙ্গে দ্বৈত ও সম্মিলিত গানই করেননি; আমার সুরেও গেয়েছেন। দেশাত্মবোধক গান ছাড়াও আমার সুরে প্লেব্যাক করেছেন ‘স্বামী-স্ত্রীর ওয়াদা’ ছবিতে। প্লেব্যাক বিষয়ে তিনি সবসময় খুব সচেতন ছিলেন। প্রতিটি গানের পেছনে তার যে শ্রম, নিষ্ঠা, একাগ্রতা চোখে পড়ত, তা খুব কম শিল্পীর বেলায় দেখা গেছে। তার অনেক কিছুর মতো এই বিষয়টাও আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করে। এ কারণেই দেশীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে এন্ড্রু কিশোরের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে তার অবদান যে কতখানি, তা কথায় প্রকাশ করা যাবে না।
একটা বিষয় অনেকের হয়তো জানা নেই। তাহলো তিনি প্রথম পুরুষ কণ্ঠশিল্পী, যিনি বলিউডে প্লেব্যাক করেছেন। রাহুল দেব বর্মণের সংগীত পরিচালনায় ‘বিরোধ’ ছবির একটি গানের হিন্দি ও বাংলা দুই ভার্সনে কণ্ঠ দিয়েছিলেন তিনি। অথচ এই অভিজ্ঞতার কথা কখনও তিনি কোথাও বলে বেড়াননি। হয়তো এ কারণেই তার শিল্পীজীবনের অনেক অভিজ্ঞতা ও অর্জন অনেকের আড়ালে থেকে গেছে। তারপরও এটাই সত্যি যে, তার মতো শিল্পী যুগে যুগে আসে না। একজন এন্ড্রু কিশোরের তুলনা করা যায় শুধু তার সঙ্গেই।