নয়াবার্তা প্রতিবেদক : রাজধানীর মহাখালীর আমতলী এলাকার খাজা টাওয়ারে আগুন লাগার ঘটনায় ৪০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্রডব্যান্ড গ্রাহক সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। কারণ, ওই টাওয়ারে গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো কোম্পানির ডেটাসেন্টার ও সার্ভার রয়েছে। যেগুলোর সঙ্গে সারা দেশের বেশিরভাগ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) ও ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) যুক্ত রয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) ভবনে লাগা আগুনে কয়েকটি ফ্লোর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার কারণে খাজা টাওয়ার ভবনের সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এতে সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা ও মোবাইল সেবায় অনেকটা বিঘ্ন ঘটছে বলে জানিয়েছে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ। এছাড়াও ভবনে থাকা বিভিন্ন ইন্টারনেট সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, সারা দেশে ইন্টারনেট সেবাগ্রহিতার ৪০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্রডব্যান্ড গ্রাহক এই সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় ইন্টারনেট সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে কিছু কিছু অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা দিতে আমাদের সার্ভার ডিসেন্ট্রালাইজড করা হচ্ছে। এতেও সবখানে সঠিকভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
দেশের ইন্টারনেট সেবা পুনরায় সচল করতে হলে খাজা টাওয়ারে থাকা ডেটা সেন্টার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করার দাবি করছেন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠানগুলো।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া বলেন, সারা দেশে ৫০০ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার ইন্টারনেট পাচ্ছে না। এই ক্ষতির কারণে ৪০ শতাংশ মানুষ কোনোভাবে ফেসবুক, ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, আমাদের যে পরিমাণ ব্যাকআপ সিস্টেম আছে সেটা অপ্রতুল। ফেসবুক এবং গুগলের ডাটাবেজ রয়েছে। রবি ডিভাইস আছে এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যাকআপ সার্ভিস রয়েছে। এই ক্ষতির কারণে আগামীকালও সমস্যা হতে পারে। যদি ফায়ার সার্ভিস অনুমতি দেয় তাহলে গুগল আপ করতে সময় লাগবে ঘণ্টাখানেক আর ফেসবুক চালু করতে সময় লাগবে ২৪ ঘণ্টা।
খাজা টাওয়ার ভবনের ৩য় তলায় ফার্স সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ৪র্থ তলায় গ্রামীণফোন ডেটা সেন্টার, ১০ তলায় আর্থ টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড, রেস অনলাইন, অরবিট টেলিকম। ১১ তলায় এনআরবি টেলিকম, এছাড়া ভবনের বাকি ৭টি ফ্লোরে সাইফ পাওয়ার টেক গ্রুপ।
ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান রেস অনলাইনের ডেপুটি ম্যানেজার (বিজনেস ডেভেলপমেন্ট) কাজী মাহতাবউল ইসলাম বলেন, এই ভবনে অনেক ইন্টারনেট প্রোভাইডার ও ডেটা সেন্টার প্রতিষ্ঠান রয়েছে৷ এখান থেকে দেশের বড় একটি অংশ ইন্টারনেট সেবা ও মোবাইল সেবা পেয়ে থাকে। কিন্তু এখানে আগুন লাগার কারণে এই সেবা বন্ধ রয়েছে। দেশের প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ গ্রাহক এখন সেবা পাচ্ছে না। তিনি বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে তথ্য আসছে ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। কোথাও কোথাও গতি ধীর হয়ে পড়েছে। আবার কোথাও ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমাদের ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার হার্ট (হৃদয়) হলো খাজা টাওয়ারে। এখন এই হৃদয় কাজ করছে না। তাই ডিসেন্ট্রালাইজড করে কিছু অঞ্চলে আমাদের সেবা চালু রেখেছি। কিন্তু অনেক এলাকায় ঠিকমত সেবা দেওয়া সম্ভর হচ্ছে না। যদি এখানে (খাজা টাওয়ারে) আমাদের সার্ভার চালু করা যায় তবে আমরা সবাই সঠিক সেবা পাবে৷ কিন্তু ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। যার কারণে দেশের বড় একটা অংশ ইন্টারনেট ও মোবাইল সেবা সঠিকভাবে পাচ্ছে না বলে যোগ করেন তিনি।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ার টেক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তরফদার মোহম্মাদ রুহুল আমিন বলেন, আগুন নির্বাপনের জন্য সংশ্লিষ্টরা তাৎক্ষণিকভাবে খুবই ভালো কাজ করেছে। ফলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেকটা কম হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিটি ফ্লোরে পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছিল। সেই সঙ্গে দুই মাস অন্তর অন্তর আমাদের অফিসগুলোতে অগ্নিনির্বাপক মহরা করা হতো। আগুন লাগার পরপরই আমাদের কর্মীরা এক্সট্রিংগুইশার ব্যবহার করেছিল তাই আগুন বেশি ছড়াতে পারেনি। আমরা ধারণা করছি, আমাদের তৎপরতার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কম হতে পারে। তবে এই ক্ষতি রিকভার করে কবে নাগাদ আমাদের অফিস চালু করতে পারব তা এখনো কিছু বুঝতে পারছি না। তিনি বলেন, আমাদের কোম্পানির অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট পুরোটাই পুড়ে গেছে। অন্যান্য অফিসগুলো অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের ব্যাপক পরিমাণে ক্ষতি হয়েছে। তবে আমাদের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা না থাকলে এই ক্ষতি আরও বেশি হতে পারতো। তিনি আরও বলেন, অগ্নিকাণ্ডে মোট তিনজনের মধ্যে আমাদের অফিসের একজন সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার মারা গেছেন। এছাড়া আমাদের অনেক কর্মী এখনো হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
ভবন মালিকের পক্ষ থেকে অগ্নি নির্বাপনের কতটুকু ব্যবস্থা ছিল তা সঠিক জানি না। অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থার কিছু যন্ত্র আমাদের ছিল। গতকাল চল্লিশটির মতো ফায়ার এক্সট্রিংগুইশার আমরা নিজেরা ব্যবহার করেছি।
বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) বিকাল ৪টা ৫৮ মিনিটে রাজধানীর মহাখালীর আমতলীতে খাজা টাওয়ারে (১৪ তলা ভবন) আগুনের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট ঘটনাস্থলে চেষ্টা চালিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
এরপরও ভবনের ভেতরে থেকে থেকে আগুন জ্বলছিল ও ধোয়া হচ্ছিল। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার প্রায় ১৩ ঘণ্টা পর শুক্রবার (২৭ অক্টোবর) সকাল ৮ টা ৪৫ মিনিটে ভবনের আগুন সম্পূর্ণভাবে নির্বাপন করা হয়।
এই ঘটনায় খাজা টাওয়ার ভবনের আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সহযোগিতায় অংশ নেয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা। আগুনের এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুই নারী ও এক পুরুষসহ মোট তিন জনের মৃত্যু হয়েছে।
অগ্নিনির্বাপনের পর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত খাজা টাওয়ার ভবনটি বুঝে নেয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। সকাল থেকেই ভবনের প্রধান ফটকে অবস্থান নেয় বনানী থানা পুলিশের একটি টিম। ভবনে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক/কর্মী ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলেও তাদের কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
পুলিশ বলছে, ভবনের নিরাপত্তা ও ভেতরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মূল্যবান সরঞ্জামাদির নিরাপত্তার স্বার্থে এখনই কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
এদিকে, ফায়ার সার্ভিস বলছে, খাজা টাওয়ারের ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না। ভবনটিতে দাহ্য পদার্থ বেশি থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শট সার্কিট থেকে এই আগুনের সূত্রপাত ঘটতে পারে৷
এবিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ভবনের ফ্লোরগুলোতে ব্যাটারি, স্টোরস, ক্যাবেল, সুইচ, আইসোলেসন ফোম এবং ১২ ও ১৩ তলাতে ইন্টেরিয়র দিয়ে খুব সুসজ্জিত করা। যা আগুন ছড়িয়ে যাওয়ার বিশেষ উপাদান। একারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়াও খাজা টাওয়ারের ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না। ভবনটিতে দাহ্য পদার্থ বেশি থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই ভবনের আগুনের সূত্রপাত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তদন্ত সাপেক্ষে বলা যাবে।