নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : বছরজুড়ে ধুন্ধুমার বেচাকেনা। লাভও পকেটে ঢোকে ষোলো আনা। শুধু সরকারি কোষাগারে ভ্যাট বা মূসক (মূল্য সংযোজন কর) না দিতেই যত ফিকির। এমন অভিযোগ অনেক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বহু পুরনো। এমন অনেক ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান আছে, ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করে না। সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে রাজধানীর নামিদামি বিভিন্ন শপিং মলে কেনাকাটা করতে গিয়ে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া এমন অনেক ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের খোঁজ মেলে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযানে নেমেও নামিদামি শপিং মলের বেশির ভাগ দোকানে ভ্যাট নয়ছয়ের প্রমাণ পেয়েছেন। অভিযানে গিয়ে এসব ভ্যাট ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠানকে পাওনা পরিশোধের জন্য নির্দিষ্ট সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়। হিসাবমতো রাজস্ব পরিশোধ না করলে ভ্যাট গোয়েন্দারা কখনো কখনো মামলা করারও হুঁশিয়ারি দেন।
এনবিআর সূত্র জানায়, কয়েক বছরে ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সাড়ে সাত লাখ হলেও নিয়মিত রিটার্ন দিচ্ছে ৩০-৩২ হাজার প্রতিষ্ঠান। অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে।
পণ্যের দামের সঙ্গে নির্দিষ্ট হারে ভ্যাট যোগ করে বিক্রেতারা হিসাব কষে ঠিকই ক্রেতার কাছ থেকে তা আদায় করে। বেশির ভাগ ক্রেতা ভ্যাটের পরিমাণ না জেনেই পণ্যের দামের হিসাবে তা পরিশোধে বাধ্য হয়। আদায় করা ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে বেশির ভাগ বিক্রেতা নিজের পকেটেই রেখে দেয়। কয়েক বছরে গড়ে ৩০-৩২ হাজার প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করলেও সারা দেশে লাখ লাখ ভ্যাট ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠান ছড়িয়ে আছে।
ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান ভ্যাট ফাঁকি দিলেও এনবিআরের লোকবলের অভাবে তাদের সবাইকে এত দিন চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি ভ্যাট গোয়েন্দারা বিভিন্ন শপিং মলে ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে অভিযানে নেমেছেন। অভিযানে দেখা গেছে, সারা বছর ভালো বেচাকেনা করে এক পয়সাও ভ্যাট দিচ্ছে না বা নামমাত্র ভ্যাট দিচ্ছে—এমন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানই বেশি। এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান ভ্যাট নিবন্ধন পর্যন্ত নেয়নি।
তিনি বলেন, এনবিআর থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, প্রত্যেক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রদর্শিত স্থানে অনলাইনে গ্রহণ করা ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর বাধ্যতামূলক ঝুলিয়ে রাখতে হবে। না রাখলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। নিবন্ধন নম্বর না নেওয়া মানেই হলো নিশ্চিত ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া।
রাজধানীর মিরপুর, ধানমণ্ডি, গুলশান, বাড্ডা, ফার্মগেট, উত্তরা ঘুরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এসব এলাকার অধিকাংশ বড় বিপণিবিতানে সারা বছর ভালো বেচাকেনা হয়। উৎসব-পার্বণে বেচাকেনা আরো বাড়ে। এসব দোকান থেকে সরকারি কোষাগারে একটি টাকার ভ্যাটও জমা দেওয়া হয় না। অথচ এসব বিপণিবিতানে ক্রেতার কাছ থেকে ভ্যাটের কথা বলে পণ্যের সঙ্গে বাড়তি টাকা নেওয়া হয়। ক্রেতাকে ভ্যাট গ্রহণের কোনো চালান দেওয়া হয় না।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিরপুর শপিং সেন্টারের নিচতলার ৭ নম্বর দোকান রাকিব এন্টারপ্রাইজ। শপিং সেন্টারের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে শেষ সারির ওই দোকানে দেশি-বিদেশি ক্রোকারিজ গিফট পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করা হয়। ওই দোকান থেকে এক হাজার ৫০ টাকার ক্রোকারিজ কিনে ভ্যাট পরিশোধের চালান চাওয়া হয়। জবাবে বিক্রয়কর্মী বলেন, ‘আমাদের এসব চালান কাউকে দেওয়া লাগে না।’ দোকানে অনুপস্থিত মালিককে উদ্দেশ করে বলেন, ‘এসব ভ্যাটফ্যাট মালিক জানে।’ দোকানে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর প্রদর্শিত স্থানে নেই কেন জানতে চাওয়া হলে বলেন, ‘এসব আমরা রাখি না।’
একই শপিং মলের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই হাতের বাঁ পাশের আরেক দোকান সোবা গোল্ডেন রোজে গিয়েও অনলাইনে নিবন্ধিত ভ্যাট সনদ প্রদর্শিত স্থানে দেখা যায়নি। ওই দোকানের বিক্রয়কর্মীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আছে ভাই, ফাইলের মধ্যে। সরকারের লোকজন এলে মালিক কথা বলে।’
রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকার একাধিক শপিং মলে গিয়ে দেখা যায়, ভালো বেচাকেনা চললেও দোকানের প্রদর্শিত স্থানে ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব দোকানের অধিকাংশই ভ্যাট নিবন্ধন নেয়নি। রাজধানীর জেনেটিক প্লাজার নিচতলায় জুনায়েদ মেচিং সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, দোকানের একমাত্র বিক্রয়কর্মী ক্রেতা সামলাতে ব্যস্ত। ভ্যাট পরিশোধ করে কি না বা ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর দোকানে প্রদর্শিত স্থানে নেই কেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমাদের এসব লাগে না।’
রাজধানীর প্রগতি সরণির মধ্যবাড্ডা এলাকার বেশির ভাগ দোকানেই ভ্যাট প্রদানের অনলাইন নিবন্ধন ফরম ঝোলানো হয়নি। কেউ কেউ ফাইলের মধ্যে রেখে দিয়েছে—এমন কথা বললেও পরে দেখাতে পারেনি।