জাভেদ হুসেন : মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট মহাকাব্যে ‘মহান মোগলদের আগ্রা আর লাহোর’ শহরের কথা আছে সৃষ্টির বিস্ময় হিসেবে। ওলন্দাজ শিল্পী রেমব্রান্ত মোগল মিনিয়েচার দেখে মুগ্ধ হয়ে সেই আদলে এঁকেছেন ২৪টি ছবি। তবে মোগল বৈভবের চূড়ান্ত আর শেষ প্রতীক হলো ‘স্বপ্নের শহর’ দিল্লি। সেই শহর ধসে পড়ে বিলীন হওয়ার সাক্ষী উর্দু কিংবদন্তি মির্জা গালিব। তাঁর চোখের সামনে পতন হলো মোগল যুগের। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল প্রকৃতির রোষ—মহামারি, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খাদ্যাভাব এবং শেষে দুর্ভিক্ষ। ইংরেজ প্রবর্তিত নতুন ডাক ব্যবস্থায় গালিব প্রতিদিন চিঠি লিখতেন বন্ধুদের। পুরোনো অলংকারসর্বস্ব গদ্যের জায়গায় তিনি প্রবর্তন করেন আধুনিক উর্দু গদ্যের। সেই চিঠিগুলোতে প্রাত্যহিক খুঁটিনাটিসহ পাওয়া যায় তাঁর জীবৎকালের সব ঘটনা।
মারি এসেছিল গালিবের সময়েও। একবার নয়, বারবার। দিল্লি আজ আবারও মহামারিতে আক্রান্ত। গত বছর সেসব দেখে গুলজার কবিতা লিখেছিলেন, ‘গলি কাসিম জান ২০২০’ শিরোনামে। এ গলিতেই ভাড়া বাড়িতে থাকতেন গালিব। গুলজারের সেই কবিতার এক জায়গায় আছে:
মহামারি ছড়াল, গালিব বললেন তাঁর বুড়িকে
একাত্তর বছরের আমি, আর তুমি সত্তর বছরের
দুজনের একজন মরলেও বুঝতাম,
হ্যাঁ, এসেছে মহামারি।
গালিব সে সময় ২০ বছরের যুবক। বিয়ে করে দিল্লিতে এসেছেন বছর সাতেক আগে। তখন শুরু হয় পৃথিবীর প্রথম কলেরা মহামারি, যার সূচনা আজকের যশোরে, ১৮১৭ সালে। এরপরই আবার ১৮২৯–এ। পুনরায় মারি আঘাত হানল ১৮৪০ সালে। পরে ১৮৫২–তে আরেক দফা। এই কলেরার উপদ্রপ ছড়িয়েছিল দিল্লিতেও। তবে ভয়াবহ কোনো প্রভাব ফেলেনি। অন্তত গালিবের চিঠিপত্রে এই দুর্যোগের তেমন উল্লেখ নেই। তখনো কবি নিজের কাব্যখ্যাতি আর প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে হতোদ্যম হননি। তাঁর স্বাস্থ্যও অটুট।
এল ১৮৫৬। এ বছরের মে মাসে যে কলেরা মহামারি শুরু হলো, তা ছড়িয়ে পড়ল গোটা উত্তর ভারতের সমতল ভূমিতে। দক্ষিণ ভারত থেকে পশ্চিমে মুলতান পর্যন্ত জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিল কলেরা। শুরু হয়েছিল মোগলদের এককালীন রাজধানী আগ্রা থেকে। সেই বছরের জুন মাসে তা পৌঁছে গেল দিল্লি।
সেবার বর্ষায় দিল্লিতে প্রবল বৃষ্টি হলো। বিপর্যস্ত শহরে প্রশাসন আর নগর ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে বহু আগেই। বৃষ্টির পানি জমেছে শহরজুড়ে। একসময় পানি নেমেও গেল। রেখে গেল নোংরা আর আবর্জনার স্তূপ, জলবাহিত কলেরা রোগের জন্য যা আদর্শ। রোগ ছড়িয়ে পড়ল দ্রুতগতিতে।
শামসুর রাহমান ফারুকি তাঁর কয়ি চাঁদ থে সরে আসমাঁ উপন্যাসে লিখেছেন, কলেরা এত প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছোট থেকে বড় অফিসাররা দায়িত্ব ফেলে দিল্লি ছেড়ে পালিয়ে বাঁচল। স্থানীয় দেশি চিকিৎসকেরা যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। চিকিৎসা জুটল অভিজাতদের ভাগ্যে। সাধারণ মানুষ মারা যেতে লাগল বিনা তদবিরে। বহু আগে নাদির শাহের আক্রমণে মোগল সম্রাট মুহাম্মদ শাহ রঙ্গিলা অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এর ১১৭ বছর পর বাহাদুর শাহ জাফর অসহায় আত্মসমর্পণ করলেন এক অদৃশ্য শত্রু কলেরার সামনে।
এই মারি মোগল সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করেছিল। কলেরায় মারা গেলেন মোগল যুবরাজ–পরবর্তী সম্রাট মির্জা ফখরু। সেই সুযোগটি কাজে লাগাল ব্রিটিশেরা। আর কোনো যুবরাজকে পরবর্তী সম্রাট হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি হলো না তারা। লাল কেল্লায় কোণে কোণে তখন প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। এর মধ্যে ঘটে গেল ১৮৫৭–এর মহাবিদ্রোহ। কলেরার ভয়ে পালানো ইংরেজশূন্য দিল্লিতে সিপাহিরা প্রবেশ করল সহজে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ইংরেজ আবার দখল করল দিল্লি। কয়েক মাস পরে আবার বাড়ল কলেরার প্রকোপ।
এসবের ফলে জীবন ওলটপালট হয়ে গেল গালিবের। অপ্রকৃতিস্থ ছোট ভাই মির্জা ইউসুফ রাস্তায় বের হয়ে ইংরেজের গুলিতে মারা গেলেন। বহু কষ্টে পুরোনো চাদরের কাফনে তাঁর কবর হলো।
মোগল সাম্রাজ্য নেই। দরবারের চাকরি খোয়ালেন গালিব। মাসোহারা পাওয়া তো দূরের কথা, দরবারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বলে প্রাণ বাঁচানোই দায় হলো। সব কবিতার খসড়া যেখানে গচ্ছিত রেখেছিলেন, সে বাড়ি ইংরেজরা পুড়িয়ে দিল। সব কবিতার খাতা পুড়ে ছাই। আকুতিভরা ভাষায় চিঠিতে তিনি পরে বন্ধুদের বলেছেন, কারও কাছে যদি চিঠিতে কোনো কবিতা পাঠিয়ে থাকি তাহলে আমাকে লিখে পাঠাও। গাইয়ে ভিক্ষুকদের কাছ থেকে আবার সংগ্রহ করেছেন নিজের লেখা পুরোনো গজল।
সেই মন্দ দিন আর কাটেনি। ১৮৬০ সালে আবার ফিরে এল কলেরা। সঙ্গে দুর্ভিক্ষ। ১৮৬০–এ শফক নামে এক বন্ধুকে চিঠিতে কবি লিখেছেন, ‘পাঁচ লুটেরা বাহিনী নেমে এল এই শহরে একের পর এক। প্রথমে বিদ্রোহী সৈনিকেরা লুটে নিল শহরের সুনাম। এরপর এল ইংরেজ—লুটে নিল প্রাণ, সম্পত্তি, আবাস, আসমান আর জমিনে প্রাণের সব চিহ্ন। তৃতীয় এল দুর্ভিক্ষ—হাজার মানুষ মরল অনাহারে। এরপর এল কলেরা—যাদের পেটে খাবার ছিল এবার তারা মরল। শেষে এল জ্বর—কেড়ে নিল প্রতিরোধের শেষ শক্তি।’
দিল্লিতে কলেরার বাড়বাড়ন্তির পেছনে দায়ী ছিল ইংরেজরা। মহাবিদ্রোহের পর শহর দখল করে তারা প্রথম দিল্লির পুরোনো চেহারা ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিল। পরিকল্পনা ছিল, লাল কেল্লা আর জামা মসজিদ গুঁড়িয়ে সেই জায়গায় ক্যাথেড্রাল ও ভিক্টোরিয়া প্রাসাদ তৈরি হবে। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। তবে অন্যান্য অধিকাংশ সৌধের সঙ্গে লাল কেল্লা হলো সৈনিকদের ব্যারাক। পুরোনো বসতি এলাকা মাটিতে মিশিয়ে তৈরি হলো চওড়া সড়ক। রাতারাতি গৃহহীন হলো হাজারো মানুষ। আগের পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ভেঙে পড়ল। নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলায় দিল্লির চেয়ে অগ্রাধিকার পেল কলকাতা। এলোমেলো এই অবস্থায় অচল হয়ে গেল দিল্লির পানিনিষ্কাশন। ফলে বদ্ধ জল আর জমে থাকা আবর্জনা কলেরার ‘নরক’ নামিয়ে আনল দিল্লিতে।
নিজের অস্তিত্বের অংশ দিল্লি শহর চোখের সামনে শেষ হতে দেখে চিঠিতে গালিব লিখেছিলেন, ‘দিল্লি শহর জনশূন্য হয়ে গেলে আমি আনন্দ করব। সবাই যখন এ শহর ছেড়ে চলে যাবে, তখন আর শহরটিকে নিয়ে দুঃখ করার কিছু থাকবে না আমার।’
দিল্লিতে সেবার বর্ষায় প্রবল বৃষ্টি হলো। দিল্লিবাসী বহুকাল এমন দেখেনি। গালিবের ভাড়ার পুরোনো বাড়ির সর্বত্র জল পড়ে। এখানে–সেখানে ঘটিবাটি রেখে পানি সামলাতে হয়। কোথাও একটানা বসে চিঠি লেখাও মুশকিল। তাঁর নিজের ভাষ্যে, ‘আকাশ থেকে যদি বৃষ্টি পড়ে এক ঘণ্টা তো ছাদ থেকে পড়ে চার ঘণ্টা!’
বছর ঘুরতেই চলমান মহামারিটি ভয়ংকর রূপ নিল। ১৮৬১–তে বন্ধু মজরুহকে কবি লিখলেন, ‘মহামারির কথা আর কী জানতে চাইছ? ভাগ্যের দক্ষ তিরন্দাজের হাতে এই একটা তিরই বাকি ছিল। এত হত্যা, এত লুটপাট, এমন তীব্র দুর্ভিক্ষ—মহামারি আর বাদ থাকে কেন?’
তত দিনে গালিব জীবনের প্রতি আকর্ষণ হারিয়েছেন। নিতান্ত খাওয়া–পরা জোগাড় করা কষ্টকর হয়ে গেছে। বাজারে বংশপরিচয়ের সূত্রে ধারদেনা অবশ্য পেতেন। কিন্তু ইংরেজ যুগে সেই সুনামের আর বাজারদর নেই, তা বরং বিপদই ডেকে আনে। জ্যোতিষচর্চায় তিনি আমোদ পেতেন। বছর দশেক আগে নিজেই নিজের ভাগ্য গণনা করে বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর বছর হবে ১৮৬০ সালে। মজরুহকে লেখা সেই চিঠিতে পরিহাসপ্রিয় কবি জানাচ্ছেন যে তাঁর গণনা ভুল ছিল না। তবে ‘সাধারণ এক মহামারিতে মরা আমার ঠিক শোভন মনে হয়নি। এতে নিজের মান-মর্যাদা থাকে না। এই দুর্যোগ কাটুক, তারপর ভেবে দেখা যাবে।’ চিঠির শেষে ছিল একটি শের:
সব দুর্যোগ হয়েছে শেষ গালিব
এক অতর্কিত মৃত্যু বাকি আছে শুধু।
তবে সহজে যে গালিব পার পেয়েছিলেন, এমন নয়। ১৮৬১–এর নভেম্বরে রামপুরের নবাবকে লেখা তাঁর চিঠিতে জানা যায়, গালিব জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। সঙ্গে শূলবেদনা। তবে সে ব্যথায় কবি জ্বরের কষ্ট টের না পেয়ে বলেছেন, ‘আমার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। মানসিক অবসাদ নিয়ে এসেছে মৃত্যুর দ্বারে।’
সে যাত্রাতেও মরা হলো না গালিবের। জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে রইলেন। তিনি সবচেয়ে কষ্ট পেতেন বন্ধুশূন্য একাকী জীবনে। কিন্তু সমাজব্যবস্থা এখন পাল্টে গেছে। তিনি এখন বিগত যুগের স্মৃতিচিহ্ন যেন। মজলিশি মানুষ ছিলেন। চারপাশে বন্ধুরা ঘিরে থাকত। তাদের অনেকে যুদ্ধে, অনেকে কলেরায় মারা গেছে। কয়েকজন ফাঁসিকাঠে বা আন্দামানে। এরা সবাই ছিলেন গালিবের প্রত্যেহের সঙ্গী। সে কথা মনে করে ১৮৬৩–এর চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ওপর তলায় যে ঘরে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আসর জমত, সেখানে বসে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকি। দেখতে পাই যেন মির মেহেদি, ইউসুফ মির্জা, মিরান আর ইউসুফ আলী খান একে একে আসছে—আল্লাহ, আল্লাহ! সহস্রবার তাদের জন্য বিলাপ করি। কিন্তু আমি যখন থাকব না, আমার জন্য শোক করার কে রইল?’
অসহ্য নিঃসঙ্গতা, চোখের সামনে নিজের জগৎ চিরকালের জন্য শেষ হয়ে যেতে দেখে কবিতায় লিখেছিলেন:
যেখানে কেউ নেই এমন কোথাও থাকি এবার
ভাষা বোঝার থাকবে না কেউ
থাকবে না কেউ কথা বলার
দেয়াল–দরজা যেন নেই
এমন ঘর বানানো যেত যদি—
থাকবে না কেউ পাশে আমার না
থাকবে কোনো প্রতিবেশী;
রুগ্ণ হলেও থাকবে না কেউ শুশ্রূষাকারী
যদি মরে যাই করবে না কেউ আহাজারি।
গালিবের শরীর ভেঙে পড়েছে। পয়সাপাতি নেই। বাজারে টাকা দিয়েও আনাজপাতি পাওয়া যায় না। নতুন ব্যবসায়ীরা আর আগের যুগের নীতির ধার ধারে না। অনাবৃষ্টিতে ফসল হয়নি। যা আছে তা সব গুদামে রেখেছে ব্যবসায়ীরা। গালিবের কথায় তখন ‘মৃত্যু খুব সস্তা আর শস্য মহার্ঘ।’
১৮৬৩ সালে দিল্লিতে এল নতুন অসুখ, ইংরেজরা যাকে বলে ‘দিল্লি সোর’—মাছিবাহিত এক চর্মরোগ। এতে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হলেন গালিব। ডান পা আর দুই হাতে বড় ফোড়া দেখা দিল। তা থেকে ক্ষত। ক্ষত কাটা হলো। এবার পা দুটি এমন ফুলে গেল যে জুতোও পায়ে গলে না। সারা গায়ে ব্যান্ডেজ ও মলম লাগিয়ে যন্ত্রণায় জেগে রাত কাটান। এমন দুর্বল হয়েই বললেন, ‘শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াতে এত সময় লাগে যে সেই সময়ে একটা মানুষ–সমান দেয়াল গেঁথে ফেলা যায়।’
১৮৬৯ সালে গত হওয়ার আগে আর শক্তি ফিরে পাননি মির্জা গালিব। তবে বিগতকালের মহিমাকীর্তন না করে ভিত্তি তিনি গড়ে দিয়েছিলেন ভারতবর্ষের নতুন কাব্যের; মারি–মড়ক–দুর্ভিক্ষ পেরিয়ে সেই কাব্যে গালিব লিখেছিলেন:
দেয়াল–দরজা ভেদ করে আসছে সবুজ,
হে গালিব
আমি পড়ে আছি বিরান মরুতে,
ঘরে বসন্ত এসেছে।