মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আর মেকি আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট যেন তলাবিহীন ঝুড়ি

নয়াবার্তা প্রতিবেদক :  প্রায় দুই দশক ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন সাকিব আল হাসান। জয় থেকে তখন ২১ রান দূরে বাংলাদেশ, বল ছিল ১৮টি। হাতে তিন উইকেট। ততক্ষণে থিতু হয়ে গেছেন সাকিব। কিন্তু বিশ্বব্যাপী টি-টোয়েন্টির ফেরিওয়ালা হয়ে থাকা এই অলরাউন্ডার ম্যাচটা জেতাতে পারলেন না! কী আশ্চর্য! তাহলে সাকিবের এই অভিজ্ঞতার মূল্য কোথায়? অথচ দলে কোনোরকম অবদান রাখতে না পেরেও সংবাদ সম্মেলনে দাম্ভিকতা দেখিয়ে গেলেন সাকিব!

২০০৬ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলে বাংলাদেশ। গত ১৮ বছরে ১৬৮টি ম্যাচ খেলে একটি জায়গাতে অবশ্য সবার ওপরে শান্ত-সাকিবরা। সবার আগে হারের সেঞ্চুরি পূর্ণ করেছে বাংলাদেশ। ৬৪ জয়ের বিপরীতে হার ১০০ ম্যাচে। বাকি চারটি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে। এই লম্বা সময়ে এই ফরম্যাটে নিজেদের যোগ্য দল হিসেবে গড়ে তুলতে পারেনি বাংলাদেশ, যেন ক্রিকেটে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সিরিজ হারের পরও যদি ঘুম না ভাঙে জাতীয় দল সংশ্লিষ্টদের, তাহলে বুঝতে হবে এই সংকট আর কাটানো যাবে না। হয়তো কেনিয়ার মতোই বাংলাদেশের ক্রিকেটও একটা সময় বিলীন হয়ে যাবে!

যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে চলমান টি-টোয়েন্টি সিরিজে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স লেজেগোবরে। তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম দুটিতে লজ্জার হার দেখে মুখ লুকাচ্ছেন ক্রিকেট ভক্তরা। ক্রিকেটের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে সংকট আজকের নয়। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও মেকি আত্মবিশ্বাস দেখিয়ে একটি দল কতখানিই বা এগোবে? একটা সময় তো সংকটে পড়তেই হবে। বাংলাদেশ দল এর আগেও নানা সময়ে সংকটে পড়েছে, কিন্তু কথার লড়াইয়ে সেসব নিমিষেই ঢাকা পড়ে গেছে। গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই রিপোর্ট কোথায়? বিশ্বকাপের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও সেই রিপোর্ট জনসমক্ষে আসেনি! বাংলাদেশের ক্রিকেট কর্তারা নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতেই এমন পরিস্থিতি তৈরি করে আসছেন। ব্যর্থতায় ক্রিকেটারদের শতভাগ দায় দেওয়া হলেও কর্তারা থাকেন আড়ালে!

বিশ্বকাপ এখনও শুরু হয়নি। তবে তিন ম্যাচের এই সিরিজেই সম্ভাব্য ফলাফলের ট্রায়াল হয়ে গেছে। ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ‘বিশ্রী’ ক্রিকেট খেলার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ‘পরের’ মাঠেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষাতে দেখা যায়নি কোনও প্রাণ। ২২ গজে নেমে ক্রিকেটারদের ইনটেন্ট, প্রসেস, পরিকল্পনার ঘাটতি ছিল স্পষ্ট। সবমিলিয়ে শান্ত-সাকিব-লিটনদের নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে। প্রায় দুই দশক ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন সাকিব আল হাসান। জয় থেকে তখন ২১ রান দূরে বাংলাদেশ, বল ছিল ১৮টি। হাতে তিন উইকেট। ততক্ষণে থিতু হয়ে গেছেন সাকিব। কিন্তু বিশ্বব্যাপী টি-টোয়েন্টির ফেরিওয়ালা হয়ে থাকা এই অলরাউন্ডার ম্যাচটা জেতাতে পারলেন না! কী আশ্চর্য! তাহলে সাকিবের এই অভিজ্ঞতার মূল্য কোথায়? অথচ দলে কোনোরকম অবদান রাখতে না পেরেও সংবাদ সম্মেলনে দাম্ভিকতা দেখিয়ে গেলেন সাকিব! ক্রিকেটভক্তরা এইসব দেখে বিস্মিত হচ্ছেন, হচ্ছেন হতবাক।

যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচ হারের পর বাংলাদেশের সিরিজ হার নিশ্চিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক, সবচেয়ে বিব্রতকর হার এটাই! ছোট দলের বিপক্ষে এর আগেও বাংলাদেশ হেরেছে, তবে পরিস্থিতি আর প্রেক্ষাপট এক ছিল না। এভাবে বিধ্বস্ত হওয়ার পরও সাকিব সংবাদ সম্মেলনে যে সুরে কথা বলে গেছেন, সেটি দেখাও ভক্তদের জন্য ভীষণ বিব্রতকর। সাকিবের কথাতে দম্ভ, অহংকার সবকিছু যেন বেরিয়ে এলো। যা ভীষণরকম আহত করেছে ক্রিকেটপ্রেমীদের। সাকিবের বক্তব্য নিয়ে চলছে তীব্র সমালোচনাও।

এদিকে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা বুঝতেই পারছেন না, কেন তারা পারফরম্যান্স করতে পারছেন না। সাকিব তো স্পষ্ট করেই বলে দিলেন, ব্যর্থ হওয়ার কারণ তার জানা নেই। এত বছর ধরে ক্রিকেট খেলা বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটারই যদি নিজেদের ভুলগুলো বুঝতে না পারেন, বাকিরা কীভাবে বুঝবেন? প্রায় প্রতি ম্যাচেই ব্যাটারদের দুর্বলতা ফুটে উঠছে। অধিনায়ক শান্ত ব্যাটারদের স্কিলের সমস্যা নেই বলে স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন। তবে কোথায় সমস্যা? তার উত্তর মানসিকতায়- এই সমস্যা কীভাবে দূর করা সম্ভব, তার কি কোনও উত্তর আছে? এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার, ব্যক্তি নিজেই এই সমস্যা সমাধান করতে পারবে, অন্যকেউ অন্যের হয়ে এই সমস্যা সমাধান করার সুযোগ নেই। সবচেয়ে বড় কথা লম্বা সময় ধরে ক্রিকেট খেলার পরও ক্রিকেটারদের মানসিকতার ঘাটতি থাকে কী করে। এর উত্তর অবশ্য কারও কাছেই নেই।

শুধু ব্যাটিং করতে নেমেই যে সমস্যায় পড়ছে তা নয়। ফিল্ডিংও ভালো হচ্ছে না। বোলিংয়ে পরিকল্পনার ঘাটতি স্পষ্ট। নিজেদের মাঠে অতিথি দল ভালো খেলছে। বাইরের দেশে গিয়ে নিজেদের কন্ডিশনের মতো উইকেট পেয়েও সুবিধা করতে পারছে না বাংলাদেশ। অনেকটা মিরপুরের মতোই কিছুটা স্লো ও টার্নিং উইকেট ছিল হিউস্টনের প্রেইরি ভিউ ক্রিকেট কমপ্লেক্সে। কিন্তু কী করেছে বাংলাদেশ, সেটি সবারই জানা হয়ে গেছে। ক্রিকেটাররা মুখে কথার তুবড়ি ছোটান। হেরে যাওয়া ম্যাচ খেলে ইতিবাচক দিক খুঁজে বের করেন। সেগুলো নিয়ে কাজও করেন। কিন্তু দিনশেষে সেইসব কাজ ২২ গজে দেখা যায় না।

এখানে সবচেয়ে বড় আলোচনা মিরপুরের উইকেট নিয়ে। মিরপুরের এমন মন্থর ও টার্নিং উইকেটে খেলে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন অনেকেই। সাকিব এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, মিরপুরের উইকেটে ১০-১৫টা ম্যাচ খেললে ব্যাটারের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ হারের পর শান্তও জিম্বাবুয়ে সিরিজে ভালো উইকেটে খেলতে না পারার অজুহাত দিয়েছিলেন। তবে বাংলাদেশ দলের ব্যাটাররা যেভাবে ব্যাটিং করছে, তাতে করে সাকিবের করা ভবিষ্যদ্বাণী মিলেই যাচ্ছে। কাগজে কলমে কোনও ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার শেষ না হলেও বর্তমান পারফরম্যান্স তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে অজুহাত হিসেবে মিরপুরের উইকেটকে হয়তো কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে। তাতে করে ব্যাটারদের দায় কিন্তু কোনোভাবেই এড়ানো যাবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। নবীন প্রতিপক্ষের কাছে দুই ম্যাচ হেরে সিরিজ খোঁয়ানো লজ্জারই বটে। ক্রিকেটপ্রেমীরা লজ্জা পেলেও ক্রিকেটাররা কি লজ্জা পাচ্ছেন? টিম ম্যানেজমেন্ট কি খুঁজে বের করতে পারছেন, তাদের সমস্যা কোথায়? প্রধান কোচ হাথুরুসিংহের প্রতি এখনও কি আস্থা রাখবেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। নাকি কোনোরকমে আরও একটি জয়ে সবকিছু আগের মতোই হয়ে উঠবে! সেই সব উত্তর সময়ের হাতেই তোলা থাকুক!

Share