যেকোনো পরিস্থিতি সহনশীলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : সাম্প্রদায়িক অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান প্রকাশের পাশাপাশি যেকোনো পরিস্থিতি সহনশীলতার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য দলীয় নেতাকর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে কথা ওঠানোর চেষ্টা হয়েছে। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। এদেশে সব ধর্মের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে চলবে। সবাইকে বলবো, যেকোনো পরিস্থিতি সহনশীলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। কে কী বললো, সেটি না শুনে দেশ ও জনগণের জন্য কতটুকু করতে পারি- সেটিই সবার চিন্তায় থাকতে হবে। তাহলেই আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবো, সঠিক কাজটি করতে পারবো। সেভাবেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে দলীয় নেতাকর্মীসহ সবাইকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন, জাতির পিতা ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন। সেই বাংলাদেশ গড়ে তুলতে তার আদর্শ বুকে নিয়ে মানুষের পাশে থাকবো। আমরা আর কখনো কারও কাছে মাথানত করে চলব না। বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে চলবে- জাতির পিতার এই স্বপ্ন আমরা পূরণ করবই।

বুধবার মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাইকে এটুকুই বলবো, এই মাটি হিন্দু, বৌদ্ধ. খিস্ট্রান, বৌদ্ধ ও মুসলিমসহ সব ধর্মাবলম্বী মানুষের দেশ। হিন্দু-মুসলিম সবাই এক হয়ে রক্ত ঢেলে দিয়ে আমরা স্বাধীনতা এনেছি। সেই স্বাধীন দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকের যার যার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকবে। সব ধর্মের মানুষের এখানে সমান অধিকার থাকবে, সবাই শান্তিতে বসবাস করবে।

তিনি বলেন, ‘আমরা মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে অন্যদের অবহেলার চোখে দেখবো- সেটা নয়। এই বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষকে, সবাইকে সমান চোখে দেখতে হবে। ইসলাম আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়ে থাকে। আমাদের মহানবীও (সা.) সেই শিক্ষাই দিয়েছেন।’

করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা ও মানুষের জানমাল রক্ষায় সরকার এবং আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর ভূমিকা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, সরকার হিসেবে আমাদের দায়িত্বটা পালন করে যাচ্ছি। করোনা মহামারির সময় মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। প্রণোদনার মাধ্যমে অর্থনীতিকে গতিশীল করার চেষ্টা করছি। প্রতিটি মানুষের সমস্যা শুনে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি।

তিনি বলেন, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে যেমন কাজ করছি, তেমনি আওয়ামী লীগও কাজ করছে। প্রতিটি সংকটেই আওয়ামী লীগ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এই করোনা সংকটে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দলের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ ও যুব মহিলা লীগসহ প্রতিটি সংগঠনই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, মানুষের পাশে থেকে তাদের সেবা করাই আওয়ামী লীগের কাজ। এই কাজ আমরা করে যাচ্ছি, করে যাবো। সেই সঙ্গে আগামীর জন্য যেসব কর্মসূচি হাতে নিয়েছি- সেগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে আজকের বাংলাদেশকে সামনের দিকে নিয়ে যাবো ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে।

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা আরও বলেন, সবাইকে অনুরোধ করবো, সংগঠনটাকে শক্তিশালী করতে হবে। একই সঙ্গে জাতির পিতার আদর্শকে মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। যে নামটি ‘৭৫ এর পর মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল- আজ ইউনেস্কো ঘোষণা দিয়েছে, সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই আন্তর্জাতিক পুরস্কার দেওয়া হবে। অর্থনীতিতে যারা অবদান রাখতে পারবেন, তাদেরই এই পুরস্কার দেওয়া হবে। মুজিব শতবর্ষে জাতির জন্য এটা বড় উপহার বলে মনে করি।

আগামী দিনগুলোতেও করোনাসহ যেকোনো সংকট মোকাবিলায় জনগণের পাশে দাঁড়ানো অব্যাহত রাখার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও বলবো প্রতিটি সময় আপনারা মানুষের পাশে দাঁড়ান। এই করোনাভাইরাসের সময় আমাদের প্রতিটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা মানুষের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ফলে অনেক মানুষের সেবা করতে গিয়ে অনেক নেতাকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন, অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। এই কাজটাই অব্যাহত রাখতে হবে।’

করোনা দুর্যোগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি মানুষের সমস্যার সমাধানে সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কারণ এই করোনাকালেও মানুষের জীবন-জীবীকা সচল রাখতে হবে। তারপরও বলবো, এই দুর্যোগে সবাইকে মাস্ক পড়তে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলতে হবে। সাবান বা স্যানিটাইজার ব্যবহার করে হাতটা পরিষ্কার রাখতে হবে। আর ঘোরাঘুরি একটু কম করতে হবে। সবাই সুস্থ থাকার চেষ্টা করবেন, মাস্ক পরে থাকবেন।

করোনা পরিস্থিতিতে শারীরিকভাবে কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না পারার বিষয়টিকে ‘জেলখানার বন্দিজীবন’-এর সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘আমার খুব দুঃখ লাগছে- সবাই ওখানে (আলোচনা সভার প্রান্তে) আর আমিই যেন জেলখানার মত বন্দিজীবনে বসে আছি। এই পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই। কীভাবে এই অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে, সেটি এখনো কেউ জানি না। তবে আমরা ভ্যাকসিন আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ভ্যাকসিন পেয়ে যাব।’

বক্তব্যের শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রাম এবং এর বিজয় অর্জনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে স্বাধীনতাত্তোর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সরকারের নানা পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন।

এ প্রসঙ্গে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার গৃহীত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনলেই বোঝা যাবে- তিনি কেন দ্বিতীয় বিপ্লবের এই কর্মসূচি দিয়েছিলেন। তিনি দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির ডাক দিয়ে এই কর্মসূচি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু আর পাঁচটি বছর সময় পেলে এবং তার কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতে পারতো।

তিনি বলেন, কিন্তু বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি যারা দেশের স্বাধীনতাই চায়নি- তারা বুঝতে পেরেছিল বঙ্গবন্ধুর এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে তারা দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এই কারণে তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

এ প্রসঙ্গে পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনায় তার বাবা-মা-ভাইসহ পরিবারের সবাইকে হারানোর দুঃসহ যন্ত্রণার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমি হারালাম আমার মা-বাবা সবাইকে। আমি জানি আপনজন হারানোর বেদনা কী!’ পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক সরকারগুলোর দুঃশাসনের কথাও তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।

দেশ ও জাতির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন ও মানুষের কল্যাণে তার সরকার গৃহীত পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আজকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছেছে। ২০২৪ সালে সেই স্বীকৃতিও আমরা পেয়ে যাবো। ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা আধুনিক, উন্নত ও সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। সেটাই আমাদের লক্ষ্য। আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ২১০০ সালে বাংলাদেশকে আমরা কীভাবে দেখতে চাই- সেজন্য বদ্বীপ পরিকল্পনা করে দিয়েছি। যাতে করে আজকের যে শিশু, ভবিষ্যতেই সেই যেন একটি আধুনিক সমৃদ্ধ উন্নত দেশের নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। আজ বিজয় দিবসে এটুকুই বলব- এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা যে, আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলব।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউ প্রান্তে আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আরও বক্তব্য দেন- আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী এমপি, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম এমপি, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী। গণভবন প্রান্ত থেকে সভা পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ এমপি।

Share