রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের ১,৬০০ কোটি টাকা আটকে আছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে

নয়াবার্ত‍া প্রতিবেদক : রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক অগ্রণী, জনতা সোনালী ও রূপালীর ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা আটকে আছে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) কাছে।

ব্যাংকগুলোর ২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এর মধ্যে ১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে রাখা হয়েছে এবং বাকি অংশ কল মানি মার্কেটের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হয়েছে।

ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), এফএএস ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, প্রিমিয়ার লিজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স, ফারইস্ট ফাইন্যান্স ও ইউনিয়ন ক্যাপিটাল। দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আমানত আটকে থাকায় প্রশ্ন উঠেছে, ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের আগে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করেছে কি না।

এছাড়াও আর্থিক সংকটে থাকা কয়েকটি ব্যাংকে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা রেখেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দাবি, তাদের এই বিনিয়োগের কারণ আকর্ষণীয় সুদের হার। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভুল বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আমানত রেখেছে ব্যাংকগুলো অথবা অনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য এটি করা হয়েছে। এমনকি অন্তত এক দশক ধরে লোকসানে থাকা আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও ব্যাপক অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারিতে ধুকতে থাকা পদ্মা ব্যাংক (পূর্বের নাম ফারমার্স ব্যাংক) এই চারটি ব্যাংক থেকে আমানত আকৃষ্ট করতে পেরেছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি জানি না, কেন ব্যাংকগুলো দুর্বল ব্যাংক বা ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাদের অর্থ রেখেছে। হয়তো রাজনৈতিক চাপ থাকতে পারে।”ব্যাংকগুলোর উচিত তাদের পরিস্থিতি যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ রাখা,’ বলেন তিনি।

বিআইএফসি, এফএএস ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, আইএলএফএসএল, পিপলস লিজিং, প্রিমিয়ার লিজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স, ফারইস্ট ফাইন্যান্স ও ইউনিয়ন ক্যাপিটালের কাছে ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপ্ট (এফডিআর) হিসেবে ৪০৯ কোটি টাকা রেখেছে অগ্রণী ব্যাংক।

পদ্মা ব্যাংকে ২০০ কোটি টাকা এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে ৬ কোটি ৯০ লাখ টাকার এফডিআর এখন আটকে আছে অগ্রণী ব্যাংকের। একইসঙ্গে কল মানি মার্কেটের মাধ্যমে এফএএস ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, বিআইএফসি, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং ও প্রিমিয়ার লিজিংকে ৫১ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। এছাড়াও, পদ্মা ব্যাংকের সাবঅর্ডিনেটেড বন্ডে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে তারা।

অগ্রণী ব্যাংক তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তারা এনবিএফআইয়ে রাখা অর্থ ফেরত পেতে চেষ্টা করছে। কিন্তু, প্রতিষ্ঠানগুলো মেয়াদপূর্তির পরও এফডিআরের অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না।

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা বেশিরভাগ এফডিআর থেকে তারা ঠিকভাবে সুদ পাচ্ছেন। তবে সম্প্রতি কিছু ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিজেদের সমস্যার কারণে তারা টাকা দিতে পারছে না। তিনি বলেন, একটি বিশেষ পরিস্থিতির কারণে পদ্মা ব্যাংকে বিনিয়োগ করা হয়েছিল এবং সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংককে বিনিয়োগ করতে হয়েছিল। তবে, ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাবঅর্ডিনেট বন্ডে বিনিয়োগ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিয়মিত সুদ পাচ্ছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সাবেক এই গবেষণা পরিচালক বলেন, বর্তমান সংকটে পড়ার আগে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করছিল। তাদের ব্যবসাও ভালো ছিল। ‘অনেক মানুষই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ করে সমস্যায় পড়েছেন, কিছু প্রতিষ্ঠান খারাপ করায় এই খারাপ ভাবমূর্তি পুরো সেক্টরকে প্রভাবিত করেছে। ফলে কিছু ভালো ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানও সংকটে পড়েছে। অনেক ব্যাংকের এফডিআর এসব প্রতিষ্ঠানে আটকে গেছে,’ বলেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশের ৩৫টি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টি রেড জোনে ছিল, ২০২১ সালে যা ছিল ১২টি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুনে এনবিএফআই খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো সাধারণত কোনো দুর্বল প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ বা তহবিল রাখতে চায় না। কিন্তু, কখনো কখনো পরিচালকদের প্রভাব বা রাজনৈতিক চাপের কারণে এটা করতে হয়। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় শীর্ষ কর্মকর্তারাও সুবিধার বিনিময়ে দুর্বল প্রতিষ্ঠানে অর্থ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। সুতরাং, এখানে কঠোর তদন্ত ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার।’ তিনি মন্তব্য করেন, এনবিএফআই সেক্টরের দুর্দশার মূলে আছে বড় ধরনের অনিয়ম।

২০২০ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শনে পিপলস লিজিং, আইএলএফএসএল, প্রিমিয়ার লিজিং, উত্তরা ফাইন্যান্স ও ফার্স্ট ফাইন্যান্সসহ এক ডজন এনবিএফআইয়ের ব্যাপক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির তথ্য উঠে আসে।

রূপালী ব্যাংক কয়েকটি এনবিএফআইয়ে এফডিআর খুলে ৫৬৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া পদ্মা ব্যাংকে ১১০ কোটি টাকা ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে ১৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকার এফডিআর আছে রূপালী ব্যাংকের। রূপালী ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা হারুনুর রশীদ বলেন, ‘রূপালী ব্যাংক যখন এনবিএফআইয়ে অর্থ রেখেছিল তখন তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল, মূলধন শক্তিশালী ছিল এবং খেলাপি ঋণ কম ছিল। কিন্তু, তারা এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে তখন তা অনুমান করা কঠিন ছিল।’ তিনি বলেন, ‘এটা ছিল অপ্রত্যাশিত। এখন আমরা এনবিএফআইগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। এনবিএফআইগুলো সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলতে পারে।’

সোনালী ব্যাংক পদ্মা ব্যাংকে ২৪০ কোটি টাকা, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে সাড়ে ১৪ কোটি টাকা ও বিভিন্ন ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১৬৪ কোটি টাকা রেখেছে।

জনতা ব্যাংক ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে পদ্মা ব্যাংকে ১৯০ কোটি টাকা, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে ১৪ কোটি টাকা ও বিভিন্ন ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২৫৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।

এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল জব্বার ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তারা ফোন ধরেননি।

ফার্স্ট ফাইন্যান্সের হেড অব ট্রেজারি হাসিনা জান্নাত বলেন, মূলত তারল্য সংকটের কারণে তারা অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। ‘আমানত পরিশোধের ক্ষেত্রে আমরা ব্যক্তিগত আমানতকারীদের অগ্রাধিকার দিচ্ছি। বড় ধরনের ঋণ আদায় করা সম্ভব হলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে অর্থ ফেরত দেওয়ার পরিকল্পনা করছি,’ বলেন তিনি। তিনি জানান, একটি নন-লিস্টেড প্রতিষ্ঠানের কাছে ফার্স্ট ফাইন্যান্সের অনেক পাওনা আছে, সেই অর্থ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে।

আইএলএফএসএলের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান বলেন, বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে আমাদের প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ও অন্যান্য এনবিএফআই ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা দেনা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘তারল্য সংকটের কারণে আমরা অর্থ পরিশোধ করতে পারছি না’। তিনি জানান, কোম্পানিটি ইকুইটি বেস পুনর্গঠন করছে এর মাধ্যমে আগামী মাসগুলোতে একটা সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ট্রেজারি কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার বলেন, রাষ্ট্র পরিচালিত ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ এফডিআর খোলা হয়েছিল যখন এটি ওরিয়েন্টাল ব্যাংক নামে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছিল। ২০০৮ সালে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে যখন আইসিবি করা হয় তখন ব্যাংকটির দায় ছিল ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ওপরে। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪০০ কোটি টাকায়। মো. দেলোয়ার আরও বলেন, ‘আমরা ধীরে ধীরে আমাদের আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিচ্ছি এবং সুদও দেওয়া হচ্ছে।’

Share