রিমান্ডে নারীকে যৌন নির্যাতনের ‘প্রমাণ মেলেনি’

নিজস্ব জেলা প্রতিবেদক : বরিশালের উজিরপুর মডেল থানায় হত্যা মামলার নারী আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের ঘটনা হঠাৎ করে ভিন্ন দিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। অভিযোগকারী ওই নারী এ ঘটনায় আদালতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্কেল এএসপি) এবং উজিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এ ছাড়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে থানার ওসিসহ দুই কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

ওই নারী যেসব পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তও চলছে। কিন্তু তিনি যে অভিযোগ করেছেন, তার কোনো সত্যতা পাচ্ছেন না স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। ওই নারীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হলেও প্রতিবেদনে তার অভিযোগের কোনো ‘সিম্পটম’ পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, নিজেকে ভুক্তভোগী দাবি করা ওই নারীর মামলার পর আদালতের নির্দেশে শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু প্রাপ্ত প্রতিবেদনে তার অভিযোগের ভিত্তিমূলক কোনো তথ্য ছিল না। অর্থাৎ তাকে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে, এর কোনো সত্যতা মেলেনি। অভিযোগকারীর শরীরে যে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে, তা অনেক পুরোনো বলেও উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে।

গত ৩ জুলাই আদালত এবং পুলিশের কাছে পাঠানো শেবাচিম হাসপাতালের গাইনি বিভাগের (ইউনিট-২) নারী কর্মকর্তা মিনতি বিশ্বাস ওরফে মিতু অধিকারী নামের ওই নারীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। পরীক্ষার পর তৈরি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

যদিও মেডিকেল রিপোর্টে কী আছে, সে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন বলে দাবি করেছেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচএম সাইফুল ইসলাম। তাছাড়া ঘটনাটি বিচার এবং তদন্তাধীন থাকায় এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

উল্লেখ্য, গত ২৬ জুন বরিশালের উজিরপুর উপজেলার জামবাড়ি এলাকায় পরকীয়া প্রেমিকার বাড়ির পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় বাসুদেব চক্রবর্তী টুলু নামে এক ব্যক্তির মৃতদেহ। ওই ঘটনায় নিহতের ভাই বরুন চক্রবর্তী বাদী হয়ে ২৭ জুন উজিরপুর মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় নিহতের পরকীয়া প্রেমিকা মিনতি বিশ্বাস মিতুকে একমাত্র আসামি করা হয়। ২৮ জুন গ্রেপ্তার করা হয় মিতু অধিকারীকে। পরবর্তী ২৯ জুন পুলিশের আবেদনে বরিশালের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (উজিরপুর) আমলী আদালত তাকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে গত ২ জুলাই আসামি মিনতি বিশ্বাসকে আদালতে হাজির করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উজিরপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মাইনুল ইসলাম। এ সময় আদালতের বিচারকের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেন মিনতি।

আসামি আদালতকে জানান, ৩০ জুন সকালে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাকে তার নিজ কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে জোর করে হত্যা মামলার স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করেন। এ জন্য নারীর শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিয়ে যৌন নির্যাতন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। কিছুক্ষণ পরে এক নারী পুলিশ সদস্যকে ডেকে এনে মারধর এবং পরবর্তীতে তদন্ত কর্মকর্তা নিজেও ১৫-২০ মিনিট ব্যাপক মারধর করেন তাকে।

আদালত অভিযোগ শুনে ওই নারীকে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান এবং তাকে নির্যাতনের বিষয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেডিকেল প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলেন শেবাচিম হাসপাতাল পরিচালককে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী গত ৩ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে পাঠান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

শেবাচিম হাসপাতাল থেকে পাঠানো ওই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামি মিনতি বিশ্বাসের দুই কনুই, পায়ের গোড়ালিসহ ৬টি স্থানে ৬ থেকে ৮টি আঘাত রয়েছে। তবে সবগুলোই অনেক পুরানো আঘাত। আঘাতের গুরুত্ব সিম্পল (নরমাল) বলে মেডিকেল রিপোর্টে রোগীর বিস্তারিত বিবরণে উল্লেখ করেছেন চিকিৎসক। অবশ্য আঘাতগুলো কতটা পুরানো সে বিষয়ে উল্লেখ নেই তদন্ত প্রতিবেদনে।

শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আদালত নির্দেশে নারী চিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। ওই চিকিৎসক মেডিকেল রিপোর্ট খামে ভরে আমাকে দিয়ে গেছেন। তিনি যেভাবে দিয়েছেন সেভাবেই আদালতে পাঠিয়েছি।’ রিপোর্টে কী আছে দেখার সুযোগ হয়নি বলে জানান পরিচালক।

নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক উজিরপুরের জামবাড়ি এলাকার ওই নারীর কয়েকজন প্রতিবেশী জানিয়েছেন, মিনতির দুজন স্বামী ছিল। তাদের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। মিনতির বাবা-মাকে ছেড়ে জামবাড়ি গ্রামে ঘর ভাড়া নিয়ে একাই বসবাস করেন। বাসুদেব নামে যাকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে তার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই পরকীয়ার সম্পর্ক চলছিল মিনতির। বাসুদেব এক সময় ট্রাক চালক ছিলেন। পরকীয়ার সূত্র ধরে বাসুদেব এর কাছ থেকে অনেক অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন মিনতি। সম্প্রতি বাসুদেব ট্রাক চালোনার কাজ ছেড়ে দেন। তারপর থেকে মিনতির চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে ব্যর্থ হন। এরপর থেকেই দুজনের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব সৃষ্টি হয়।

বরিশালের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান বলেন, ‘একজনের নামে অভিযোগ আসতেই পারে। কিন্তু সব অভিযোগ কি সত্য হয়? অবশ্যই অভিযোগের প্রমাণ থাকতে হয়। তারপরেও আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী উজিরপুরের দুই ওসিকে ক্লোজড করা হয়েছে। একজন এএসপি এবং দুইজন ওসিসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ডিআইজি কার্যালয় থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি এই ঘটনায় বিভাগীয় মামলা হয়েছে।’

সুষ্ঠু তদন্তে সবকিছু পরিস্কার হবে জানিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর নেওয়া হবে।’

Share