নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : নারায়ণগঞ্জে খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে দেলোয়ার হোসেনের মাইক্রোবাস থামানো হলো ট্রাফিক সার্জেন্ট পরিচয়ে। হাতে থাকা কালো রঙের ওয়াকিটকিটি বারবার নাচাতে নাচাতে গাড়ির কাগজ চাইতে লাগলেন তিনি। কিন্তু চালক তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারেন, ওয়াকিটকি হাতে নিয়ে কথা বলা মানুষটি আসলে প্রতারক চক্রের একজন। চলতি বছরের শুরুর দিকে ঘটে এই ঘটনা।
কোমরে ওয়াকিটকি নিয়ে মোটরসাইকেলে যশোরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন এক তরুণী। বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলতেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা পরিচয়ে। কখনও হয়ে যেতেন গণমাধ্যমকর্মী। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর জানা গেল, ওই তরুণী মাদক ব্যবসায়ী!
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট কার্যালয়ে কালো রঙের ওয়াকিটকি হাতে নিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন এক ব্যক্তি। ওয়াকিটকিটি বেশ কায়দা করে বারবার দেখাচ্ছিলেন তিনি- যেন তিনি বড় কোনো গোয়েন্দা কর্মকর্তা। সন্দেহ হওয়ায় দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা তার পরিচয় জানতে চান। তখন ওই ব্যক্তি জানান, একটি ইউটিউব চ্যানেলের মালিক তিনি!
শুধু ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ বা যশোরেই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই কালো রঙের ওয়াকিটকি হাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে একটি চক্র। এই বেতারযন্ত্র ব্যবহারের চেয়ে প্রদর্শনেই এরা ব্যস্ত থাকে বেশি। ওয়াকিটকি হাতে থাকা ব্যক্তিদের আচরণে ভড়কে যান সাধারণ মানুষও। কারণ তাদের হাবভাবে মনে হয়, তারা যেন পুলিশ আর গোয়েন্দা কর্মকর্তা!
শুধু এই অপরাধী চক্রই নয়, কালো রঙের ওয়াকিটকি ব্যবহার করছে বাস কাউন্টারের পরিবহন শ্রমিক থেকে বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মী আর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কর্মীরাও। বড় কোনো জমায়েতে সাউন্ড সিস্টেম কর্মীর হাতেও থাকে আন্তঃযোগাযোগের এই বেতারযন্ত্র। কোরবানি ঈদের আগে পশুরহাটের ইজারাদারের লোকজনের হাতেও মেলে এমন ওয়াকিটকি। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরাও ব্যবহার করছেন এই ওয়াকিটকি। তারা ব্যবহারের চেয়ে তা হাতে, আবার কখনও কোমরে গুঁজে রাখেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের মতো।
যদিও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি) বলছে, কোনো ব্যক্তিকে ওয়াকিটকি ব্যবহারের লাইসেন্স দেওয়া হয় না। প্রতিষ্ঠানকে এই লাইসেন্স দেওয়া হয়। আর কালো রঙের ওয়াকিটকি শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা বা সরকারি সংস্থাই কেবল ব্যবহার করতে পারে।
গত ২৬ অক্টোবর ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজী মোহাম্মদ সেলিমের ছেলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইরফান সেলিমকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ওই সময়ে তার বাসা থেকে ৩৮টি ওয়াকিটকি জব্দ করা হয়। অবৈধভাবে কালো রঙের ওয়াকিটকি ব্যবহার করায় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। এরপরই অবৈধভাবে ওয়াকিটকি ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় আসে।
বিটিআরসির সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন খান বলেন, কোনো ব্যক্তি ওয়াকিটকি নামে এই বেতারযন্ত্র চাইলেই ব্যবহার করতে পারেন না। শুধু প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে আইন অনুযায়ী লাইসেন্স নিয়ে ওয়াকিটকি ব্যবহার করা যায়। শর্ট বিজনেস রেডিও (এসবিআর) এবং পাবলিক মোবাইল রেডিও (পিএমআর)- এই দুই পদ্ধতিতে এর লাইসেন্স দেওয়া হয়। এর মধ্যে এসবিআর ফ্রিকোয়েন্সি শুধু একটি ভবন বা একটি ফ্লোরে ব্যবহার করা যায়; পিএমআর ফ্রিকোয়েন্সি পাওয়া যায় নির্ধারিত দূরত্ব পর্যন্ত। তিনি বলেন, এই ওয়াকিটকি বা বেতারযন্ত্র হস্তান্তরযোগ্য নয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, মোবাইল ফোনের উন্নত প্রযুক্তির এই সময়েও মাঝেমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় এমন কালো রঙের ওয়াকিটকি হাতে লোকজনকে চলাফেরা করতে দেখা যায়। ওয়াকিটকি হাতে রাখা ব্যক্তিদের ভাবসাব দেখে সাধারণ মানুষও ঘাবড়ে গিয়ে ভাবতে থাকেন, সাদা পোশাকে থাকা এই ব্যক্তিরা হয়তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা কোনো গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য। এভাবে অনেক প্রতারক নিজেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে প্রতারণাও করে আসছে। বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের অপরাধীরা গ্রেপ্তারও হয়েছে।
এ রকম ওয়াকিটকি রয়েছে উল্লাপাড়া উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের কাছে। ওয়াকিটকি দিয়ে কী করেন- জানতে চাইলে ওই উপজেলার বাঙ্গালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সোহেল রানা জানান, এটি দিয়ে তারা উপজেলা প্রশাসন এবং উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে উল্লাপাড়ার জনপ্রতিনিধিরা এই ওয়াকিটকি ব্যবহার শুরু করেন। তখন উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন মো. আরিফুজ্জামান। ইউএনও বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনার আলোকে তিনি ‘র্যাপিড রেসপন্সের’ জন্য ওয়াকিটকির মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। এজন্য স্থানীয় টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ অফিস থেকে অনুমোদনও নিয়েছেন। তাদের এই দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেতরযন্ত্রের মতো নয়।
অবশ্য র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম বলেন, বিটিআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী কালো রঙের ওয়াকিটকি শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা ব্যবহার করতে পারবেন। এ ছাড়া সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরাও তা ব্যবহার করেন। অন্য কারও এই কালো রঙের ওয়াকিটকি ব্যবহারের অনুমতি নেই। কিন্তু অনেকেই এই কালো রঙের ওয়াকিটকি অবৈধভাবে ব্যবহার করে আসছে।
তিনি বলেন, বিটিআরসির অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানই কেবল এই কালো রঙের ওয়াকিটকি আমদানি করতে পারে। কিন্তু খোলাবাজারে অবৈধ পথে এসব ওয়াকিটকি আমদানি হয়। বিভিন্ন সময়ে র্যাব বিভিন্ন মার্কেটে অভিযান চালিয়ে কালো রঙের ওয়াকিটকি জব্দ করেছে।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, লাইসেন্স না নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান ওয়াকিটকি বা বেতারযন্ত্র ব্যবহার করে। এভাবে কোনো অপরাধী গ্রুপ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অন্ধকারেই থেকে যায়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, ঢাকা দক্ষিণের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইরফান সেলিম নিজের বাসায় কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে অবৈধ বেতার ফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে নিজের কর্মীদের হাতে ৩৮টি ওয়াকিটকি দিয়েছিলেন। যদিও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ এর ৫৫ ধারার (১)-এ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স ছাড়া দেশের ভূখণ্ডে বা আঞ্চলিক সমুদ্রসীমায় বা আকাশসীমায় বেতার যোগাযোগের উদ্দেশ্যে কোনো বেতার যন্ত্রপাতি স্থাপন, পরিচালনা বা ব্যবহার করতে পারবে না। কমিশন কর্তৃক বরাদ্দকৃত বেতার ফ্রিকোয়েন্সি ব্যতীত অন্য কোনো ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহারও করা যাবে না।
তবে আইনটির ৫ ধারায় বলা হয়েছে, পুলিশ, বাংলাদেশ রাইফেলস, কোস্টগার্ড, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনীসমূহ এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত অন্য কোনো নিরাপত্তা বাহিনীর প্রয়োজনে বেতার যন্ত্রপাতি স্থাপন, পরিচালনা বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৫৫ (১) ধারা প্রযোজ্য হবে না।
এ ছাড়া ওই আইনে বলা হয়েছে, সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা কোনো গোয়েন্দা সংস্থা তাদের প্রয়োজনে বেতার যন্ত্রপাতি স্থাপন, পরিচালনা বা ব্যবহার; রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত কোনো যুদ্ধজাহাজ বা সামরিক বিমানসহ অন্যান্য যানবাহনে বেতার যন্ত্রপাতি স্থাপন, পরিচালনা বা ব্যবহার করতে পারবে।