নয়াবার্তা প্রতিবেদক : আগামী নির্বাচন সামনে রেখে পর্দার আড়ালে রাজনীতিতে চলছে নানামুখী তৎপরতা। সেই তৎপরতার অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভাঙা-গড়া এবং নেতাদের দলবদলের আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপিকে নির্বাচনে নিতে সরকারি মহল থেকে নানা পদক্ষেপ আছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করা হয়। এ অবস্থায় নানামুখী চাপ তৈরি করে বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনতে কৌশল ঠিক করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি সংগঠনের ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনল। তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি একই অভিযোগে আরও বেশ কয়েকজন নেতা নজরদারিতে রয়েছেন বলেও দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
মঙ্গলবার বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজে লিপ্ত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে সেই সুনির্দিষ্ট অভিযোগটি কী– তা স্পষ্ট করা হয়নি।
শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কী– তা জানতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে দলের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, শওকত মাহমুদ ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে পর্দার আড়ালে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। এমনকি সরকারের ফাঁদে পা দিয়ে দল ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিভেদ তৈরি এবং কিছু নেতাকে আগামী নির্বাচনে নেওয়ারও চেষ্টা করছেন। একই অভিযোগে তাঁর মতো আরও বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধেও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। বিগত কয়েক বছর দলের বাইরে পৃথকভাবে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে নানা কর্মসূচি পালন করায় শওকত মাহমুদকে দুই দফা শোকজ করা হয়েছিল।
এদিকে, বহিষ্কারের সিদ্ধান্তকে দুঃখজনক উল্লেখ করেছেন শওকত মাহমুদ। দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ। সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে আমাকে সপ্তাহে চার দিন আদালতে যেতে হতো না। এত মামলাও হতো না। এর বাইরে এ মুহূর্তে কিছু বলতে চাই না।’
অনেক দিন ধরেই শওকত মাহমুদকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি। দলীয়ভাবেও এড়িয়ে চলছে তাঁকে। দলের কার্যক্রমেও আমন্ত্রণ জানানো হতো না। বোঝা যাচ্ছিল, তিনি আর দলে থাকতে পারবেন না। তবে এত দ্রুত বিএনপি তাঁর বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিল, যাতে দলের অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। টানা ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে সরকারবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে থাকা দলটি এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নিজের অনড় অবস্থান জানান দিল। যাতে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে কেউ দলের ভেতর ষড়যন্ত্র বা ভাঙন ধরানোর পরিকল্পনা করলে এমন পরিণতি ভোগ করারই ইঙ্গিত দিল দলটি।
যে কারণে বহিষ্কার : গত বৃহস্পতিবার শওকত মাহমুদের উদ্যোগে বনানীর একটি হোটেলে বিভিন্ন পেশাজীবী ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে সুধী সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ওই সভায় পেশাজীবী ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থার অনেক সাবেক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। দলীয় সূত্র জানায়, দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে না জানিয়ে এই সমাবেশ আয়োজনের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর আগে গত বছরের ৬ এপ্রিল এবং ২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর দুই দফা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শওকত মাহমুদকে কারণ দশানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল।
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছে, দলকে ভাঙা এবং জাতীয়তাবাদী শক্তির মধ্যে অবিশ্বাস ও বিভাজন বাড়াতে অনেক দিন ধরে একটি মহল সক্রিয়। আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ওই মহল আবারও তৎপর হয়েছে, যাদের মূল লক্ষ্য সরকারের উদ্দেশ্য হাসিল। তারা দীর্ঘদিন থেকে বিএনপির মূল নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে দলে ও জোটে বিভক্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। নানা কারণে ক্ষুব্ধ ও হতাশ নেতাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের সঙ্গে ভেড়াচ্ছে। দল ও জোটের এমন অন্তত ৪০ নেতার সঙ্গে বিভিন্ন সময় দেশে-বিদেশে বৈঠক হয় ওই মহলের। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতেও বিদেশে এমন বৈঠক হয়েছে।
দলের সিনিয়র নেতাদের অভিযোগ, বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির স্বপ্নে বিভোর এই অংশটির নেতৃত্বে বিগত দিনে জাতীয় প্রেস ক্লাব ও হাইকোর্টের সামনে এবং মুক্তাঙ্গনে তিনটি কর্মসূচির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর সবকটিতেই শওকত মাহমুদের ভূমিকা ছিল। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে ন্যাশনাল কমিটি ফর সিভিল রাইটস এবং জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটির ব্যানারে সুধী সমাবেশের আয়োজন করা হয়, যার নেতৃত্বেও শওকত মাহমুদ ছিলেন। এ সংগঠনের আহ্বায়ক হলেন কবি, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার এবং সদস্য সচিব হলেন শওকত মাহমুদ। ওই সমাবেশে ক্ষমতাসীন সরকারকে সরিয়ে ছোট-বড় সব দল নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করা হয়, যেটা বিএনপির প্রস্তাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অভিজাত ব্যয়বহুল হোটেলে সুধী সমাবেশ এবং নৈশভোজের আয়োজনের ঘটনাকে সন্দেহের চোখে দেখে বিএনপির হাইকমান্ড। এ অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন দলটির নেতারা। শেষ পর্যন্ত দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনা করে অবশেষে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিল বিএনপি।
বিএনপি নেতারা আরও বলছেন, শওকত মাহমুদের নেতৃত্বে বিএনপির তৃণমূলে এবং জাতীয়ভাবে একটি বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা চলছিল। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ধরনের কর্মকাণ্ড আরও বাড়তে পারে। তাই এখনই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে মত দেন তাঁরা।
সূত্র জানায়, নানা কারণে ক্ষুব্ধ বিএনপি নেতা অনেকেই দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। এমন বার্তা রয়েছে বিএনপির কাছে। মূলত তাঁদেরই সরকার টার্গেট করছে বলে মনে করেন তারা। বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও সেসব নেতাকে নির্বাচনে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে তথ্য রয়েছে বিএনপি কাছে। এ পরিস্থিতির লাগাম টানতেই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো বিএনপি।