শেষ সময়ে ৯২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, ব্যয় মেটাতে চাপ বাড়বে

নয়াবার্ত‍া প্রতিবেদক : বর্তমান সরকারের মেয়াদে অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সর্বশেষ বৈঠক হয় গত ৯ নভেম্বর। এতে ৪৪টি প্রকল্প পাস হয়। এর আগে গত ৩১ অক্টোবর একনেকে পাস হয় ৩৭টি প্রকল্প। তবে শেষ সভায় এত বেশি সংখ্যক প্রকল্প পাসের ঘটনা এর আগে ঘটেনি। যেখানে ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে এক একনেক সভায় পাস হয়েছিল সর্বোচ্চ ৩৮টি প্রকল্প।

জানা গেছে, সরকারের মেয়াদের শেষভাগে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিশ্রুতির প্রকল্প অনুমোদনের হিড়িক পড়ে। ভোটারদের মন জয় করতে শেষ সময়ে সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ আসনের অবকাঠামো উন্নয়নে দেওয়া হচ্ছে অর্থ। বাদ পড়ছেন না নবনির্বাচিত মেয়ররাও।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম চাঁদপুরে ৪ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে মেঘনা-ধোনাগোদা ঝুলন্ত সেতুর নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন নিয়েছেন। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৪ (মতলব উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলা) আসন থেকে ভোটের মাঠে নৌকা প্রতীকে লড়তে চান তিনি। এলাকায় গণসংযোগও করছেন।

অন্যদিকে, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন আড়িয়াল খাঁ নদের ওপর মীরগঞ্জ সেতু নির্মাণ প্রকল্প। আবার রাষ্ট্রপতির এলাকায় বহুল আলোচিত পাবনা জেলার ইছামতি নদী পুনরুজ্জীবিতকরণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে একনেক সভা থেকে।

মাত্র দুই একনেক সভায় নতুন করে এরকম ৮১টি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এই ৮১টি নতুন প্রকল্পে সরকারকে ব্যয় করতে হবে ৯১ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। এছাড়া কিছু প্রকল্প আছে যেগুলো ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের চেয়ে কম, ফলে পরিকল্পনামন্ত্রী নিজ ক্ষমতা বলে অনুমোদন দিয়েছেন।

সরকার একদিকে ব্যয় সাশ্রয়ী হচ্ছে অন্যদিকে প্রকল্প যাচাই-বাছাই ছাড়া অনুমোদন দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। ফলে সরকারের ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। ফলে সাশ্রয়ের জন্য সরকার যে ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে তা কাজে আসবে না বলছেন অর্থনীতিবিদরা। রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া এসব প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভোটারদের মন জয় করতে সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ আসনের অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থ দেওয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে ভোটারদের আকর্ষণের চেষ্টা থাকবে ক্ষমতাসীনদের। তারা বলছেন, নতুন নতুন প্রকল্প না নিয়ে বরং পুরোনো প্রকল্পগুলোর দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। এতে আর্থিক অপচয় কিছুটা হলেও কমবে। কেননা সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে এত বিশাল বাজেট তৈরি করা সম্ভব হবে না।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সামনে একনেক সভা হবে না তাই তাড়াহুড়ো করে প্রকল্প অনুমোদন করে নেওয়া হচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে একনেক থেকে অনুমোদন করে নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত কি না বলা মুশকিল। পরবর্তী পর্যায়ে বাস্তবায়নে হোঁচট খাবে বার বার প্রকল্প সংশোধন ও মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে। ফলে আরও একটা দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়বে প্রকল্পগুলো। আর একটা বিপদ হলো ভালো, খারাপ প্রকল্প বাছাই করা সঠিক হচ্ছে কি না নিশ্চিত করা যায় না দ্রুততার কারণে।

‘‘সামনে একনেক সভা হবে না তাই তাড়াহুড়ো করে প্রকল্প অনুমোদন করে নেওয়া হচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে একনেক থেকে অনুমোদন করে নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত কি না বলা মুশকিল। পরবর্তী পর্যায়ে বাস্তবায়নে হোঁচট খাবে বার বার প্রকল্প সংশোধন ও মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে। ফলে আরও একটা দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়বে প্রকল্পগুলো। আর একটা বিপদ হলো ভালো, খারাপ প্রকল্প বাছাই করা সঠিক হচ্ছে কি না নিশ্চিত করা যায় না দ্রুততার কারণে।’’

সরকার ব্যয় মেটাতে চাপে পড়বে জানিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকারি ব্যয়ে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য নানান পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট মোকাবিলা করতে সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। এ প্রকল্পসমূহ তাড়াহুড়ো করে এডিপিতে ঢুকে যাওয়া কিন্তু সাশ্রয়ী হওয়ার সঙ্গে যায় না। একদিকে বলছি সাশ্রয়ী হবো অন্যদিকে উন্নয়ন ব্যয় বেশি। এখন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হবে মানে এ নয় যে ব্যয় হবে। তবে এতে ব্যয় করার দরজা খুলে যায়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, গত ৩১ অক্টোবর একনেক সভায় প্রায় ৫২ হাজার ৬১২ কোটি টাকা ব্যয় সম্বলিত ৩৭টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন হবে ২১ হাজার ৫৪৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, বৈদেশিক ঋণ ২৯ হাজার ৫৬৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ১ হাজার ৪৯৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।

সরকারের বর্তমান মেয়াদ প্রায় শেষ। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে শিগগির। এ বিবেচনায় গত ৯ নভেম্বর এ সরকারের মেয়াদের শেষ একনেক সভা ছিল। শেষ বেলায় তাড়াহুড়ো করে, অধিকাংশ প্রকল্পের যাচাই-বাছাই না করে, রেকর্ড ৪৪টি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। যেখানে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ৩৮টি প্রকল্প শেষ একনেক সভায় অনুমোদন পেয়েছিল। ৪৪ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় করতে হবে ৩৯ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পে সরকারি অর্থায়ন হবে ৩০ হাজার ১২৩ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণ হিসেবে পাওয়া যাবে ৭ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা দেবে ১ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা।

এসব প্রকল্পে ব্যয় করার দরজা খুলে গেলেও কবে নাগাদ বরাদ্দ দেওয়া হবে তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। ফলে বাড়বে প্রকল্প পরিচালন ব্যয়। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যয় ও অফিস ভাড়া চালিয়ে যেতে হবে বছরের পর বছর।

রেকর্ড সংখ্যক প্রকল্প একনেক সভায় উপস্থাপন প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, দেড় মাস ধরে একনেক সভা হয়নি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে ছিলেন রাষ্ট্রীয় সফরে। এছাড়া নানান কারণে একনেক সভা হয়নি। তাই আমরা প্রকল্পগুলো অনুমোদন করে দিলাম। আমরা উন্নয়নে বিশ্বাসী, আমাদের সরকার দেশের মানুষের ভাগ্য বদলে উন্নয়ন করছে। তাছাড়া প্রকল্প অনুমোদন মানেই ব্যয় শুরু করা নয়। আমাদের আরও কিছু কাজ বাকি আছে, এ ধাপগুলো সমাপ্ত করেই ব্যয় শুরু হবে।

Share